বুধবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ওমিক্রনে চ্যালেঞ্জ টিকে থাকার

অর্থনীতির চাকা সচল রাখায় নজর, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের জীবনযাপনে ক্ষতিকর প্রভাব, ঝুঁকিতে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প, বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাত

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ওমিক্রনে চ্যালেঞ্জ টিকে থাকার

করোনাভাইরাস সংক্রমণে তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় দেশ। করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণে এর মধ্যেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড ছুঁয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে তালা ঝুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অর্ধেক জনবল নিয়ে চলছে অফিস-আদালত। করোনার আগের দুই ঢেউয়ে টালমাটাল অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ওমিক্রন। নতুন করে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়বে ব্যবসা ও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা। সেই সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পসহ অন্যান্য খাতের চ্যালেঞ্জ তো আছেই। এ ব্যাপারে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওমিক্রনের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। ইতোমধ্যেই অর্ধেক জনবল নিয়ে অফিস, গণপরিবহনে চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারখানাগুলোতে অনেক শ্রমিক আক্রান্ত হচ্ছে। মহামারিতে ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথ হয়ে পড়ছে। এর ফলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে। করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে, সক্ষমতা কমেছে। বাংলাদেশে যেমন ওমিক্রন বাড়ছে, তেমন ইউরোপ-আমেরিকাতেও বাড়ছে। আমাদের ক্রেতা কিন্তু তারা। এর প্রভাব দেশের বাজারে পড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। মানুষের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনার ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে এখনো বণ্টন বাকি আছে। এর মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউ অবশ্যই অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সরকারকে এনবিআরের রাজস্ব উন্নয়ন এবং রপ্তানির অঙ্ক না দেখে এসএমই সেক্টরের সংকটগুলো দেখতে হবে। আমাদের পর্যটন শিল্প, পরিবহন খাত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেদিকে নজর দিতে হবে। এই খাতগুলোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন।’ দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে।

এরপর লকডাউন, মৃত্যু, অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। করোনার প্রথম ঢেউয়ে চাকরি হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ, বেড়েছে দারিদ্র্য। করোনার প্রথম ঢেউয়ে আমদানি-রপ্তানি থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচক ছিল নেতিবাচক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, টাকার হিসাবে যার পরিমাণ প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে করোনায় কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। তার গবেষণায় দেখানো হয়- দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে।

মহামারির প্রাদুর্ভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিভিন্ন জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রায় ৩০ শতাংশের ওপরে লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, যা ২০১৯ সালে ২০ শতাংশের মতো ছিল। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয় বৈষম্যের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এক দিনে মারা গেছে ২৬৪ জন মানুষ। দফায় দফায় লকডাউনে স্থবির ছিল জনজীবন। নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল বিপদ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সবজির বাজারে ছিল আগুন দাম। এই ধাক্কা সামলিয়ে ওঠার আগেই দরজায় কড়া নাড়ছে ওমিক্রন। তৃতীয় ঢেউয়ে দুলছে দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির সবশেষ অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলা হয়, ২০২১ ও ২০২২ সালে উন্নয়নশীল এশিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের ধারণার চেয়ে কমবে। বিশ্ব অর্থনীতির টানাপোড়েনের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও।

দেশে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ধাক্কা ওমিক্রনের নেতিবাচক প্রভাব ব্যাংকিং খাতসহ পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটি বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া চিঠিতে এ কথা উল্লেখ করে বলেছে, কভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হঠাৎ তীব্রতর হওয়ায় দেশের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া বিরূপ প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। অর্ধেক জনবল নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে কভিড পুনরায় বিস্তার লাভ করায় লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ও ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করেছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এবার লকডাউনে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নাও হতে পারে। কারণ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়ালেও তা ডেল্টার চেয়ে জটিল কম বলা হচ্ছে। কিন্তু গত বছর জুন-জুলাইতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছে, তার প্রভাব এখনো আছে। অর্থনৈতিক সেই ক্ষতিটা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠেনি দেশ। তিনি আরও বলেন, গত বছর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, নতুন করে গরিব হয়েছে তাদের উন্নয়ন ঘটেনি। তাই তাদের ক্ষেত্রে সহযোগিতাটা আরও বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বড় শিল্প-কারখানা বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি আসেনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারে প্রভাব ফেলছে করোনা। ক্রেতাদের উপস্থিতি, সামর্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পুরনো ক্ষতিই এখনো পূরণ হয়নি, এর মধ্যে নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটাকে আরও বাড়িয়ে দেবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৯৭ জন, মারা গেছেন ২৮ হাজার ২৫৬ জন। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে শনাক্তের হার এর মধ্যেই ছুঁয়েছে ৩২ শতাংশের ঘর। হাসপাতালে বাড়ছে রোগী। সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা। করোনার শুরু থেকে ঝড় বয়ে যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের ওপর দিয়ে। আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে তালা পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এরপরে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম ঢিমেতালে চলছিল। সংক্রমণ হার কমলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খুলে দেওয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১২ বছর তদুর্ধ্ব শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার কর্মযজ্ঞ শুরু হয় জোরেসোরে। কিন্তু ওমিক্রনের প্রভাবে সংক্রমণ হুহু করে বাড়তে থাকলে আবারও বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে বিপাকে লাখো শিক্ষার্থী। দুই বছরের বেশি সময় ধরে করোনার কারণে বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষা খাত। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের আগের ঢেউগুলোতে যে ধরনের প্রভাব পড়েছে, এবারও সে রকম হবে। যদিও সরকার চেষ্টা করছে আংশিক বিধিনিষেধ দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর, ক্ষয়ক্ষতি কমানোর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি সর্বাত্মক বিধিনিষেধে গেলে নাগরিক জীবন ক্ষতির মুখে পড়বে। জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনে সেটা করতে হবে। ওমিক্রনের প্রভাবে এর মধ্যেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস অর্ধেক জনবল দিয়ে চালাতে বলা হয়েছে। এর প্রভাব জীবনযাপনে পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ওমিক্রন ইউরোপের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর রূপ নিতে পারে। কারণ ইউরোপে পুরো জনগোষ্ঠী দুই ডোজের পাশাপাশি, বুস্টার ডোজের আওতায় এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো জনগোষ্ঠীর একটি অংশ টিকার বাইরে আছে। তাই ওমিক্রনের প্রভাব জনজীবনে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর