বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

বগুড়ার ঐতিহ্য মহাস্থানের কটকটি

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

বগুড়ার ঐতিহ্য মহাস্থানের কটকটি

দেখতে চারকোনা। আকৃতি ছোট। দেখে মনে হবে বেশ শক্ত। তবে মুখে দেওয়ার পর নরমও মচমচে অনুভূত হবে। মজাদার খাদ্য পণ্যের নামটি কটকটি। সুস্বাদু খাবারটি শুধু বগুড়াতেই পাওয়া যায়। বলতে গেলে, বগুড়ার ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে পণ্যটি। মহাস্থানগড় ভ্রমণে আশা বা আশপাশের জেলায় রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। প্রতিদিন গড়ে ১৫০ মণ কটকটি বিক্রি হয়ে থাকে। বাংলার প্রাচীন রাজধানী পুন্ড্রবর্ধন বা মহাস্থানগড় ঘুরতে এসে এই কটকটির স্বাদ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন দেশি-বিদেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। বগুড়ার এ খাবারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও। প্রায় দেড়শ বছর ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে মহাস্থানগড়ের এই কটকটি। খাওয়ার সময় কটকট শব্দ হওয়ার কারণেই এই খাবার কটকটি নামেই পরিচিতি পেয়ে যায়। আগে কটকটি বেশ শক্ত ছিল। এখন অনেকটাই নরম করে বানানো হয়। কটকটির কারিগররা জানান, প্রথম দিকে কটকটি বানানো হতো গমের আটা দিয়ে। পরে স্বাদ ও মান বাড়াতে বানানোর পদ্ধতি ও উপকরণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে ভাজতে তেল ব্যবহার হতো, এখন ঘি-ডালডা ব্যবহার করা হয়। কটকটি তৈরি হয় কয়েক ধাপে। এর প্রধান উপকরণ সিদ্ধ সুগন্ধি চাল। চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। একেবারে নরম হলে সেই চাল ছেঁকে শুকানোর জন্য রেখে দিতে হয় প্রায় ১৫ মিনিট। পানি শুকিয়ে গেলে ঢেঁকি, মেশিন বা অন্য উপায়ে একেবারে মিহি আটায় রূপান্তর করা হয়। এই আটার সঙ্গে মেশাতে হয় বিভিন্ন মসলা ও সয়াবিন তেল। ভালোভাবে মিশিয়ে গাঢ় করে খামির করা হয়। এরপর আকৃতির জন্য আগে থেকে তৈরি করে রাখা ছাঁচ দিয়ে কেটে নিতে হয়। কটকটির আকৃতি সাধারণত এক থেকে দেড় বর্গইঞ্চি হয়ে থাকে। পরে কড়াইয়ে ভোজ্য তেল ও ঘি-ডালডার সংমিশ্রণে ভাজা হয়। লালচে রং ধরা পর্যন্ত চলে ভাজাভাজির পর্ব। ভাজা হয়ে গেলে গুড় বা চিনির ঘন রসে ভাজা কটকটি ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর ঠান্ডা হলেই খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায় মজাদার স্বাদের কটকটি। মহাস্থানগড় ঘিরে গড়ে উঠেছে কটকটির বিশাল বাজার। স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে শতাধিক দোকান রয়েছে। পর্যটন মৌসুমে এসব দোকানে গড়ে প্রতিদিন ২০০ মণ কটকটি বিক্রি হয়। বছরজুড়ে প্রতিদিন বিক্রি হয় গড়ে ১৫০ মণ। স্বাদ ও মানভেদে প্রতি কেজি কটকটির দাম গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। প্রতি মণ কটকটির দাম গড়ে ৪ হাজার টাকা। মহাস্থানগড়ে প্রতিদিন গড়ে ৪ লাখ টাকার কটকটি বিক্রি হয়। সে হিসেবে বছরে কটকটি বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। মহাস্থানগড়ের বড় দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে লাল মিয়া কটকটি ঘর, নাসির কটকটি প্যালেস, হামু মামা কটকটি প্যালেস, সুলতান কটকটি প্যালেস, চায়না কটকটি ঘর, আলাউদ্দিন কটকটি ভান্ডার, জিন্নাহ কটকটি ভান্ডার, ফাতেমা কটকটি প্যালেস, আল আমীন কটকটি প্যালেস, লায়েব কটকটি ভান্ডার, শাহাদত কটকটি ভান্ডার ইত্যাদি। মহাস্থানগড়ে কটকটির সবচেয়ে পুরনো দোকান লাল মিয়া কটকটি ঘর। এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ লাল মিয়া প্রামাণিকের বয়স এখন ৮৩ বছর। মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে মহাস্থানগড়ে কটকটি ব্যবসায় আসেন তিনি। শুরুতে ফেরি করে বিক্রি করতেন। এখন বিশাল শোরুমে কটকটি সাজিয়ে বসেন। প্রবীণ এই দোকানি কটকটির ইতিহাস জানাতে গিয়ে বলেন, দাদা জোহর মাহমুদ এবং বাবা মোহাম্মদ আলী প্রামাণিক গড়ে ১০০ বছর কটকটির ব্যবসা করেছেন। প্রায় ৭০ বছর ধরে তিনি নিজে এ ব্যবসার সঙ্গে রয়েছেন। সেই হিসাবে মহাস্থানগড়ের কটকটির ইতিহাস কমপক্ষে ১৭০ বছরের পুরনো। কটকটির নাম কেন হলো তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। কটকটি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কয়কেজন এবং এই অঞ্চলের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, খাওয়ার সময় কটকট শব্দ হওয়ার কারণেই এই খাবার কটকটি নামেই পরিচিতি পেয়ে যায়। আগে কটকটি বেশ শক্ত ছিল। এখন অনেকটাই নরম করে বানানো হয়।  বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি ও বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য মাহফুজুল ইসলাম রাজ জানান, যথাযথ নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বগুড়ার দইয়ের মতো মহাস্থানগড়ের কটকটির সুনামও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। দেশ বিদেশ থেকে অনেকেই আসেন বগুড়ার মহাস্থানগড় মাজার জিয়ারত করতে। তারা সবাই এই কটকটি কিনেন। দেশের বিভিন্ন মাজারের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য আছে। বগুড়ার মহাস্থানগড় মাজারের ঐতিহ্য হলো কটকটি।

 

সর্বশেষ খবর