বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

শুরু হলো অমর একুশে বইমেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

শুরু হলো অমর একুশে বইমেলা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেলেও কাগজের বইয়ের আবেদন সব সময় থাকবে। ডিজিটাল ডিভাইসে বই পড়ার চেয়ে একটা বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টে-পাল্টে পড়া অনেক আনন্দের। বই না পড়লে মনে হয় কী যেন হলো না, কী যেন জানলাম না। গতকাল বিকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলা একাডেমিতে যুক্ত হয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই মেলা হচ্ছে আমাদের প্রাণের মেলা। কোনো কারণে এই মেলা হতে না পারলে আমাদের সবারই খারাপ লাগে। বইমেলা দেরিতে শুরু করতে হলো। প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিল। এ কারণে দেরি করে শুরু করতে হলো। তিনি বলেন, আজকে ১৫ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করতে পারছি সেটাই বড় কথা। বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা, কথা বলার অধিকার। এই ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। করাচি সাহিত্য সম্মেলনে ৪৭-এ ঘোষণা হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু। তখনই প্রতিবাদ জানানো হয়। ৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রলীগ গড়ে তোলেন তিনি। অন্যান্য সংগঠন নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন। সেই পথ বেয়ে ৫২-তে প্রাদেশিক পরিষদের সভা ছিল। বাজেট সেশনে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তটাও তার দেওয়া ছিল। রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা আদায় করতে হয় আমাদের।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রাণের মেলা। সেটা না হতে পারলে সবার মন খারাপ হয়। আমাদের ভাষার অধিকারে বারবার আঘাত এসেছে। আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা, রোমান হরফে বাংলা লেখার বিষয়টি এলো। বারবারই প্রতিবাদ করা হয়েছে। একটি জাতি সবসময় উন্নতি করতে পারে ভাষা সংস্কৃতির উন্নতি হলে। প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রামে সংস্কৃতিসেবীদের ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে তার অবদানকেও মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই ও তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা যে রিপোর্ট দিত, সেগুলোতে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ভাষার জন্য রক্তদানের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি, মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগটিও পেয়েছি। এটা ধরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, অনেক আঘাত ও বাধা এসেছে। সব অতিক্রম করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির জনক বলতেন, জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অর্জনের জন্যই ছিল আমাদের সংগ্রাম।

অনুবাদের গুরুত্ব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষার গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কেবল নিজের ভাষাকে গুরুত্ব দিলেই হবে না। অনুবাদ সাহিত্য যেন আরও ভালো হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের বাংলা সাহিত্য যেন অন্য ভাষাভাষীরা জানতে পারে, সেদিকে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি অন্য ভাষার সাহিত্যও আমাদের জানতে হবে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন। এতে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নূরুল হুদা বক্তৃতা করেন।

যারা পুরস্কার পেলেন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। এ বছর পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন- কবিতায় আসাদ মান্নান ও বিমল গুহ; কথাসাহিত্যে ঝর্ণা রহমান ও বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রবন্ধ/গবেষণায় হোসেনউদ্দীন হোসেন, অনুবাদে আমিনুর রহমান ও রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, নাটকে সাধনা আহমেদ, শিশুসাহিত্যে রফিকুর রশীদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় পান্না কায়সার, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গবেষণায় হারুন-অর-রশিদ, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশবিজ্ঞানে শুভাগত চৌধুরী। আরও পুরস্কার পেয়েছেন আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনিতে সুফিয়া খাতুন ও হায়দার আকবর খান রনো এবং ফোকলোর-এ আমিনুর রহমান সুলতান।

প্রথম দিনই উপচে পড়া ভিড় :  সব জল্পনা-কল্পনা আর প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে শুরু হলো ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২২’। করোনার চোখ রাঙানির কারণে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে গতকাল ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় এবারের মেলা। ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ প্রতিপাদ্যে বিকাল ৩টায় গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এবারের মেলার ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকাল সাড়ে ৪টায় দর্শনার্থীদের জন্য মেলার প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে, বিগত বছরগুলোর মতো এবারও প্রথম দিনের মেলা প্রাঙ্গণ ছিল অসম্পূর্ণ ও অগোছালো। এবার অংশ নেওয়া ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই তাদের স্টল ও প্যাভিলিয়নের নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি। হাতেগোনা দুচারটি ছাড়া সবকটির নির্মাণ ছিল অসম্পূর্ণ। এমনকি, মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিও তাদের প্যাভিলিয়ন নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি। অবকাঠামোগত নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়া ও নিজেদের গুছিয়ে না তোলার বিষয়ে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিকেই দায়ী করেছেন প্রকাশকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন প্রকাশক বলেন, অন্যবার প্রায় ২০-২৫ দিন আগে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হলেও এবার মাত্র এক সপ্তাহ আগে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি স্টল বরাদ্দের লটারি অনুষ্ঠিত হওয়ার পরের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশকদের স্টল ও প্যাভিয়িলন বুঝিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র সাত দিনের প্রস্তুতিতে স্টল ও প্যাভিলিয়ন নির্মাণ করা সম্ভব নয় বলেই এখনো বেশির ভাগ প্রকাশক তাদের স্টল ও প্যাভিলিয়নের নির্মাণ শেষ করতে পারেননি। অন্যদিকে, কভিড পরিস্থিতির কারণে এবারের মেলা জমবে কি না লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মাঝে এরকমের সংশয় থাকলেও বইপ্রেমীরা প্রথম দিনই সে সংশয় দূর করে লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের আশার বাণী জানান দিয়েছে। গতকাল মেলার প্রথম দিনই লক্ষণীয় ছিল উপচে পড়া ভিড়। বিকাল সাড়ে ৪টায় মেলার প্রবেশদ্বার খোলার পর দর্শনার্থীরা আসা শুরু করেন। সন্ধ্যার দিকে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। গতবারের প্রথম দিনের চেয়ে এবারের প্রথম দিনে দর্শনার্থী ও বইপ্রেমীদের আগমন তুলনামূলক দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন প্রকাশকরা। মেলার প্রথম দিনে পাঠকদের আশাব্যঞ্জক উপস্থিতি দেখে এবারের মেলার সফলতা নিয়ে অগ্রিম আশাবাদ ব্যক্ত করেন বেশ কয়েকজন প্রকাশক।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বর্গফুট জায়গা নিয়ে বিন্যস্ত হয়েছে এবারের মেলার পরিসর। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

আজ থেকে প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গণ খোলা থাকবে। আর শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টায় মেলার দ্বার খোলা হবে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায়।

সর্বশেষ খবর