শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ভাবনায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা

পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলোয় সেনা মোতায়েনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সাখাওয়াত কাওসার

স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ভাবনায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা

দীর্ঘ ২৪ বছর পেরিয়ে গেলেও শান্তি ফেরেনি পাহাড়ি জনপদে। গুম, খুন আর চাঁদাবাজির আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। কিছুদিন ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে রক্তপাত বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি মগ লিবারেশন পার্টি, জেএসএস (সংস্কার গ্রুপ), জেএসএস (সন্তু গ্রুপ), ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফের (সংস্কার গ্রুপ) দ্বন্দ্বে উত্তাল তিন পার্বত্য জেলা। তবে আশার খবর, বিভিন্ন গ্রুপের শীর্ষ নেতারাই আত্মসমর্পণের কথা ভাবছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিত্যক্ত ক্যাম্পগুলোয় সেনা মোতায়েনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এর পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও গহিন অরণ্যে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযোগী করার কথা বলেছেন তাঁরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, ‘দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় পার্বত্য তিন জেলার সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্যুত হয়ে সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এতে ব্যাহত হয়েছে উন্নয়নের গতি। নতুন বিনিয়োগ করতে মানুষ ভয় পাচ্ছে। ফলে থেমে আছে কর্মসংস্থান। এখনই উচিত হবে বেসামরিক প্রশাসন তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো করে উপযোগী করা। তবে সক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সহযোগিতা তারা নিতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা বিধান করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেসব এলাকা থেকে সেনা উপস্থিতি কমে যাচ্ছে সেখানেই সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেনাবাহিনীর ওপরও হামলা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর ওপর হামলা যে অঞ্চলে হলো সেই বান্দরবানে             তুলনামূলকভাবে শান্ত পরিবেশ ছিল। কিন্তু হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, সশস্ত্র গ্রুপ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন অনেক যুবক। স্বাভাবিক জীবনের বাইরে গিয়ে গহিন অরণ্যে থেকে একদিকে যেমন স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত, অন্যদিকে পরিবারের টানও টানছে অনেককে। তারা এখন উপলব্ধি করছেন স্বাভাবিক জীবনের। কিন্তু নিজেদের সংগঠনের সদস্যদের হাতেই বন্দি বা মৃত্যু হতে পারে এমন আশঙ্কায় তারা ফিরতে পারছেন না। এজন্য সরকারের সহায়তা ও প্রতিশ্রুতি চান তারা।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী গ্রুপের কিছু সদস্য মাঝেমধ্যেই বিচ্ছিন্নভাবে আত্মসমর্পণ করেন। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমরা তা প্রকাশ করি না।’ এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যন কাজী মো. মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আত্মসমর্পণ করলে আগের চেয়ে কেন পার্বত্য অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠছে? পুরো বিষয়টি নিয়ে আবার নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তবে সবচেয়ে বাজে খবর হলো, সন্তু লারমা এখন ওপেনই বলেন তিনি আবার অস্ত্র হাতে            নিয়েছেন। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্যই নাকি তিনি এমনটা করছেন।’ তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির জন্য সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সেনাবাহিনীর পুরনো ক্যাম্পগুলো আবার চালু করতে হবে। সীমান্তবর্তী রাস্তাগুলো দ্রুত সময়ে নির্মাণ করে ২ কিলোমিটার পর পর বিজিবি ক্যাম্প বসাতে ও ক্যান্টনমেন্ট করতে হবে। স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছেন, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলভিত্তিক পাঁচটি উপজাতীয় সংগঠনের হাতে ৪ হাজারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ রয়েছে। ধীরে ধীরে এসব সংগঠনে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ে কোন্দলে মাঝেমধ্যেই গর্জে ওঠে ভয়ংকর ওইসব অস্ত্র। অস্ত্রের গর্জন ছড়িয়ে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো শান্তির পাহাড়কে করছে অশান্ত। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ব্যাপকহারে প্রাণ যাচ্ছে ওইসব সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ পাহাড়িদের।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চার সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে পার্বত্য চুক্তির পর এ পর্যন্ত সহস্রাধিক খুন হয়েছে এবং অন্তত ১ হাজার ৫০০ জন গুম হয়েছেন। খুন হওয়া মানুষের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন। এর সর্বশেষ শিকার সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান। ২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনি নিহত হন। তাঁর সঙ্গে আহত হন সেনা সদস্য ফিরোজ। পাল্টা গুলিতে তিন সন্ত্রাসী নিহত ও সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। শুধু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নয়, সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরাও।

২৯ নভেম্বর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী ইউনিয়নের দুকিলো নামক স্থানে পাহাড়ের দুই সন্ত্রাসী পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। এর মধ্যে জানং চাকমা (৩৮) গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের সশস্ত্র সদস্য। তবে জেএসএস সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র সদস্য এ ঘটনায় নিহত হলেও তার নাম জানা যায়নি। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন মো. মনু নামে এক যুবক। তার পায়ে দুটি গুলি লাগে।

২০১৮ সালের মে মাসের ঘটনা সাধারণ মানুষের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছিল। ওই বছর ৩ মে আধিপত্যের কোন্দলে ব্রাশফায়ার করে জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করে ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা। পরদিন শক্তিমানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ইউপিডিএফের (মূল) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। একই বছরের ২ মে ইউপিডিএফের সাবেক সদস্য উজ্জ্বলকান্তি চাকমাকে জেএসএসের (সংস্কার) সশস্ত্র ক্যাডাররা গুলি চালিয়ে হত্যা করে। কয়েক দিন পর ২৮ মে সাজেক উপজেলার করল্লাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) ক্যাডারদের গুলিতে ইউপিডিএফের (মূল) সদস্য স্মৃতি চাকমা, সুশীল চাকমা ও অটল চাকমা নিহত হন। এরই ধারাবাহিকতায় এখনো মাঝেমধ্যেই রক্ত ঝরে পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে।

নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র বলছেন, কেবল বান্দরবানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের চার সংগঠনের কাছে এসেছে ৫ শতাধিক আধুনিক মারণাস্ত্র। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- এলএমজি, এসএমজি, একে৪৭ রাইফেল, ৭.৬২ মিমি রাইফেল, এম-১৬ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, ০.২২ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, মর্টার, দেশি পিস্তল, দেশি বন্দুক, হ্যান্ডগ্রেনেড, রকেট লঞ্চারসহ আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্থান পুঁজি করে দুর্গম এলাকায় ক্যাম্প গড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জোগান বাড়াচ্ছে এসব সংগঠন এমন অভিযোগ রয়েছে।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, ‘শান্তিচুক্তির পর অনেক সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছিল। সেসব ক্যাম্পের অনেকটিতে নানা ধরনের সামাজিক ক্লাব কিংবা অনেকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দখল করে ফেলেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিশেষ করে পর্যটন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় এনে আরও অনেক নতুন ক্যাম্প করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’

জানা গেছে, ইউপিডিএফের বিচার ও সাংগঠনিক পরিচালক আনন্দ চাকমা দুই বছর আগে খাগড়াছড়িতে বিদেশি পিস্তল, গুলিসহ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মনোরঞ্জন চাকমার ছেলে। মহালছড়ি সেনা জোনের অধিনায়কের কাছে একটি পিস্তল, ম্যাগাজিন, ৩ রাউন্ড গুলিসহ আনন্দ চাকমা আত্মসমর্পণ করেন।

আত্মসমর্পণের আগে আনন্দ চাকমা বলেন, আদর্শহীন ইউপিডিএফের খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজির কারণে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আশায় অস্ত্রসমর্পণ করেছেন তিনি। সরকার ঘোষণা দিলে ইউপিডিএফের অনেক নেতা-কর্মী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন। তবে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের কাছে একে-৪৭, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি, একাশি ও এম-১৬-এর মতো বিপুল ভারী আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।

রাঙামাটির নানিয়ারচর সার্কেলের বিচার ও সাংগঠনিক শাখার পরিচালক আনন্দ চাকমা বলেন, ‘৩০ বছর আমি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে জীবন যাপন করেছি। দুঃখের বিষয়, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় ও তাদের উন্নতির যে লক্ষ্য নিয়ে যুবক বয়সে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম তা থেকে ইউপিডিএফ সম্পূর্ণভাবে বিচ্যুত। ইউপিডিএফের কোনো নীতি-আদর্শ নেই। তারা সবাই চাঁদাবাজি, মানুষকে হয়রানি আর ভয়ভীতি ও অন্যায়-অত্যাচার করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। গুম, খুন, হত্যা ও অপহরণই তাদের কাজ। আমারও স্ত্রী, এক ছেলে ও ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া একটি মেয়ে রয়েছে। এ কারণে অনেক ভেবেচিন্তে অন্যায়ের পথ ছেড়ে সুস্থ, স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মতো অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান। কিন্তু ইউপিডিএফ হত্যার ভয় দেখাচ্ছে। এজন্য তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছেন না।’

সর্বশেষ খবর