রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

আবাসিকে দুঃখ বেসামাল বাণিজ্যিক কার্যক্রম

শামীম আহমেদ

আবাসিকে দুঃখ বেসামাল বাণিজ্যিক কার্যক্রম

আবাসিক এলাকায় ভবনে চলছে দোকানপাটসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রম। ছবিটি রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে তোলা -জয়ীতা রায়

বাণিজ্যিক আগ্রাসনে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলো হারিয়ে ফেলছে তার আবাসিক চরিত্র। প্রতিটি বাড়িই পরিণত হচ্ছে এক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে এরই মধ্যে এসব এলাকার ভবনগুলোর বড় একটি অংশেই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে মুদি-মনিহারি দোকান, লন্ড্রি, সেলুন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, ব্যাংক, ক্লিনিক, এটিএম বুথসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দখলে চলে গেছে আবাসিক ভবনের নিচতলার পার্কিংয়ের জায়গাটিও। একই সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে অনেকেই আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করছেন। বেসামাল বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটছে বাসিন্দাদের। প্রতিদিন হাজারো বহিরাগতের আগমনে সরগরম থাকছে এলাকাগুলো। সড়কগুলোয় দিন-রাত লেগে থাকে যানজট। গভীর রাতেও হর্নের শব্দে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠছে শিশু।

নগরবিদদের মতে আবাসিক এলাকার অধিকাংশ বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে অবৈধভাবে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর গাফিলতি রয়েছে। রাজধানীর আবাসিক এলাকাকে বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত করার প্রবণতা প্রথম শুরু হয় ধানমন্ডিতে। এরপর সে প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরায়। বর্তমানে এ প্রবণতা সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। ধীরে ধীরে ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হচ্ছে পরিকল্পিত নকশায় গড়ে ওঠা অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলো।

১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে সরকার ঢাকার জনবহুল এলাকা থেকে দূরে উত্তরায় নিরিবিলি ও পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলে উত্তরা মডেল টাউন। সেখানে প্রতিটি সেক্টরে পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ও বাসিন্দাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য বাণিজ্যিক প্লটের জায়গা নির্ধারিত ছিল। বর্তমানে ওই এলাকার কোনটি আবাসিক  ও কোনটি বাণিজ্যিক ভবন তা আলাদা করা কঠিন। সরেজমিন দেখা যায়, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ এভিনিউর ১০ নম্বর ব্রিজ থেকে ১১ নম্বর চৌরাস্তা পর্যন্ত দূরত্ব ১ কিলোমিটারের কিছু কম। সড়কটির দুই পাশে রয়েছে ৪৯টি বহুতল ভবন, যার ৩৯টিতেই চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। কোনো কোনো ছয় তলা ভবনের শুধু ওপরের দুটি ফ্লোর আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক ভবনের পুরো পার্কিং এরিয়া ভাড়া দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে। অন্যান্য সেক্টরেও মূল সড়কগুলোর অধিকাংশ আবাসিক ভবনে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। শাখা সড়কগুলোর ভবনগুলোতেও বসতে শুরু করেছে দোকানপাট। ১১ নম্বর সেক্টরের এক ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী বলেন, ‘বৈধ-অবৈধ জানি না, অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই এখন লাভের আশায় আবাসিক ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিচ্ছেন। বেশি ভাড়া পান।’ ভাড়াটিয়ারা বলছেন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি ভাড়া পাওয়ায় বাড়িওয়ালারা ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়াচ্ছেন ইচ্ছামতো। এ ছাড়া ভবনের নিচের ফ্ল্যাটেই দোকানপাট গড়ে ওঠায় দিন-রাত হইচই লেগেই থাকে। ফলে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। চলাফেরায় অস্বস্তি কাজ করে। কর্মস্থলের কারণে অনেকে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। অন্যদিকে কাঠাপ্রতি ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ দেওয়ায় গুলশানের অনেকেই আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করে ফেলেছেন। এতে রাতারাতি এ এলাকার জমির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বেড়েছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। মতিঝিল-দিলকুশা থেকে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রধান কার্যালয় গুলশানে স্থানান্তর করছে। গড়ে উঠছে একের পর এক শপিং মল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের করপোরেট অফিস। একসময়ের অভিজাত ছায়াসুনিবিড় আবাসিক এলাকাটি বাণিজ্যিক স্থাপনার আড়ালে হারিয়েছে তার উপশহরের মর্যাদা।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহিদুল হাসান বলেন, ‘ঢাকার যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদনের দায়িত্ব রাজউকের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ বা ব্যবহার হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। আবাসিক প্লটে বা ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু কেউ তা মানছে না। প্রতি জোনের জন্য রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। তবু হচ্ছে। অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোয় বহুদিন ধরেই আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ছে। এ কারণে যানজট, কোলাহল বাড়ছে। অপরিকল্পিতভাবে ভবন ভাড়া করে স্কুল গড়ে উঠছে। স্কুল খোলা ও ছুটির সময় ওই এলাকা পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজউক মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান চালায়, আবার থেমে যায়। মূল সমস্যা সুশাসনের।’ নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের ফেলো ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় কিছু বাণিজ্যিক চাহিদাও থাকে। এজন্য পরিকল্পনার সময় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জোন আলাদা করা হয় যাতে অন্য কোনো কিছু আবাসিক এলাকার বৈশিষ্ট্য নষ্ট না করে। কিন্তু ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরার মতো এলাকাগুলোয় নির্বিচারে বাণিজ্যিক স্থাপনা হচ্ছে, যা আবাসিক এলাকার বৈশিষ্ট্য নষ্ট করছে। এসব বাণিজ্যিক স্থাপনা বা কার্যক্রমের অধিকাংশই অবৈধ। ধানমন্ডি ও গুলশানের কিছু এলাকায় আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিকে পরিবর্তন করা হয়েছে। এও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব এলাকায় যানবাহনের চাপ বাড়ছে। একই ভবন আবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হলে ওই ভবনের বাসিন্দারা অসুবিধায় পড়েন। ভবনের আশপাশে পার্কিং থেকে শুরু করে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। আবাসিক এলাকার চাহিদার জন্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ফার্মেসির মতো কিছু দোকানের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংক, বীমা, হোটেল সবকিছু চলে ফলে সেটা আবাসিক এলাকা থাকে না। এখন উত্তরায় গেলে তো মনেই হয় না এটা কোনো আবাসিক এলাকা। এভাবে চলতে থাকলে নিখাদ আবাসিক এলাকা বলে কিছু থাকবে না। শিশু-কিশোররা নির্মল পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ বঞ্চিত হবে। এ ছাড়া ভবন নির্মাণে পার্কিং রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু পার্কিংয়ের জায়গায়ও দোকান বসিয়ে দিচ্ছে। এতে সড়কে গাড়ির চাপ বাড়ছে।’

সর্বশেষ খবর