মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বেবিট্যাক্সি চালক থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

মোশাররফ ওরফে লম্বু মোশাররফ। শুরুটা বেবিট্যাক্সি চালক হিসেবে। এক পর্যায়ে নাম লেখান অপরাধ জগতে। যোগ দেন সাভার-আমিনবাজার-কেরানীগঞ্জ-তুরাগের আতঙ্ক গাংচিল বাহিনীতে। এ বাহিনীর হয়ে চলতে থাকে একের পর এক অপরাধ। ২০১৭ সালে বাহিনীপ্রধান আনারের মৃত্যুর পর গাংচিল বাহিনীর একাংশের নেতৃত্বে আসেন। ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণের পাশাপাশি ভূমি দখল, চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন মোশাররফ। তার হাত থেকে রেহাই পাননি পুলিশ সদস্যও। কয়েক দফা কারাভোগের পর বের হয়ে পুনরায় জড়িয়ে পড়েন আগের পেশায়। রবিবার রাতে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লম্বু মোশাররফ তার পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেফতার হয়েছেন র‌্যাব-২-এর হাতে। র‌্যাব বলছে, এ সময় তাদের থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ৪ রাউন্ড গোলাবারুদ, তিনটি বড় ছোরা, দুটি চাপাতি, দুটি চাকু, একটি চাইনিজ কুড়াল, একটি দা, একটি ফ্রেমসহ হ্যাচকো ব্লেড, একটি গ্রিল কাটার, একটি কাটার প্লাস, ৪২৩ পিস ইয়াবা, পাঁচটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- বিল্লাল হোসেন, মোহন ওরফে বাইক মোহন, সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু, রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল ওরফে ট্রলার রুবেল ও সুমন মিয়া ওরফে সুমন হোসেন। গতকাল সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, আমিনবাজার, তুরাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভারে জমি দখল, হাউজিং, নৌপথ, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি ছিল মোশাররফ বাহিনীর নেশা। বাধা পেলে হামলা, খুন, অপহরণ করত তারা। আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি জড়িত মাদক ব্যবসায়ও। এখানেই শেষ নয়, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদে বালুভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্যান্য জাহাজ আটকিয়ে চাঁদাবাজি-ডাকাতি করত তারা। মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সময় ভুক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে ‘গলা কাটা মোশাররফ’ হিসেবে পরিচিতি পান মোশাররফ। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশের ওপর হামলাসহ ১৫টির অধিক মামলা রয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাভোগও করেছেন মোশাররফ।

এই কর্মকর্তা বলেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করত মোশাররফ বাহিনীর সদস্যরা। র‌্যাব-পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা ও খুনের মামলা রয়েছে মোশাররফ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। দলের সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০। ইটভাটার মালিকদের থেকে নিয়মিত মাসিক চাঁদা আদায় করত। বিভিন্ন হাউজিং এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন, নতুন বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের জমি দখলের নামে চাঁদাবাজি করত। চাঁদা দিতে রাজি না হলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করত, চাঁদা না পেলে রাতের আঁধারে নিরাপত্তা কর্মীকে প্রহার, নির্মাণ কাজের উপকরণ জোরপূর্বক নিয়ে যেত। আধিপত্য বজায় রাখাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেত গ্রুপের সদস্যরা, নিয়ন্ত্রণ করত একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ।

জানা গেছে, লম্বু মোশাররফ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ১৯৯০ সালে ঢাকায় আসেন। প্রথমে বেবিট্যাক্সি ও সিএনজি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরে একটি হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ২০০০ সালে রাজধানীর কাফরুল থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করেন। পরে গাংচিল বাহিনীর প্রধান আনারের মাধ্যমে ওই বাহিনীতে যোগ দেন।

গ্রেফতার চোরা বিল্লাল ২০০৬ সালে মুন্সীগঞ্জ থেকে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। প্রথমে গার্মেন্ট পরে গাড়ির হেলপারের কাজ করেন। ২০১৭ সালে লম্বু মোশাররফের সঙ্গে পরিচয়ের অন্যতম সহযোগী হন। সিঁদকাটা, তালা ভাঙার পারদর্শিতার কারণে ‘চোরা বিল্লাল’ হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই, হত্যাচেষ্টাসহ ১০টি মামলা রয়েছে।

বাইক মোহন লম্বু মোশাররফের অন্যতম সহযোগী। তিনি ২০১০ সালে ভোলা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন সময় গার্মেন্টে চাকরি, রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে মোটরবাইক চালানোর কাজ করতেন। ২০১৮ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে চাকরির সময় লম্বু মোশাররফের দলে যোগ দেন। ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধে আটটির অধিক মামলায় একাধিকবার কারাভোগ করেন তিনি।

জলদস্যু সাবু মোহাম্মদপুরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময় মোশাররফ বাহিনীতে যোগ দেন। লম্বু মোশাররফের নির্দেশে তিনি বুড়িগঙ্গায় বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় বিস্ফোরকদ্রব্য, চাঁদাবাজি, হত্যাচেষ্টা, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে ছয়টি মামলা রয়েছে।

ট্রলার রুবেল ২০০৬ সাল থেকে মোহাম্মদপুরের পাশের এলাকায় ট্রলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০১৮ সালে মোশাররফ বাহিনীতে যোগ দেন। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি/ডাকাতির সময় নৌকা বা ট্রলার চালাতেন বলে ট্রলার রুবেল হিসেবে পরিচিতি পান। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় তিনটি মামলা রয়েছে।

সুমন মিয়া ঢাকার বাবুবাজারে গার্মেন্টে চাকরি ও ডিশ লাইনের কাজ করেছেন। ২০২০ সালে মোশাররফের দলে যোগ দেন। মাদক সংগ্রহ ও পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন সুমন। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মাদক ও চাঁদাবাজি সংক্রান্ত দুটি মামলা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর