শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

নীল নদের দেশে পানির জন্য হাহাকার

শিমুল মাহমুদ, দক্ষিণ সুদান থেকে ফিরে

নীল নদের দেশে পানির জন্য হাহাকার

আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা তাদের অপরিসীম ত্যাগ, কষ্ট ও পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন অনন্য উচ্চতায়। আমাদের শান্তিরক্ষীরা প্রতিকূল পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন। আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ গুণ বড় দক্ষিণ সুদানের মানুষ বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের নিষ্ঠা ও সমমর্মিতার জন্য তাদের অন্তরে লালন করেন। স্থলবেষ্টিত (ল্যান্ডলক) দেশটিতে পানির অনেক কষ্ট। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম। তাদের মাথাপিছু পানি ব্যবহারের পরিমাণও কম। দেশটির অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত গোসল করারও সুযোগ পায় না। পানির একমাত্র উৎস হোয়াইট নাইল। এটি দীর্ঘ নীলনদের একটি খরস্রোতা ধারা। পানির এত সমস্যার মধ্যেও মাটির নিচ থেকে পানি তোলার অনুমতি দেয় না তাদের সরকার।

তাদের আশঙ্কা, মাটি খননের মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে তাদের বিপুল খনিজ সম্পদ বেহাত হয়ে যেতে পারে। ফলে সেখানে নিয়োজিত জাতিসংঘের ৫২টি দেশের ১৪ হাজার শান্তিরক্ষী, মিশন এক্সপার্ট ও স্টাফ অফিসারকে এ নদের পানিই পরিশোধন করে ব্যবহার করতে হয়। পানি সংগ্রহ করতে হয় নীলনদ থেকে। পানযোগ্য পানির জন্য এ দেশটিতে যেন কারবালার মাতম চলছে। প্রতিদিন সশস্ত্র পাহারা দিয়ে পানির লরিগুলো নদের তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ এক অন্যরকম যুদ্ধযাত্রা। নদের তীরে পানি তোলার পাম্প বসানো আছে। সেখান থেকে পানিভর্তি লরিগুলো আবার সশস্ত্র পাহারা দিয়ে বিভিন্ন দেশের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে যেন পানির জন্য কারবালার যুদ্ধ চলছে। নদে গোসল করছে দিগম্বর সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। কারও প্রতি কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। গোসল সেরে সংক্ষিপ্ত কাপড় পরে যার যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। অনভ্যস্ত চোখে এ দৃশ্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর লাগে। বাতাসে তখন ৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রার উত্তাপ। মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে চলতে পারে!

পানির অভাবে অনভ্যস্ত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদেরও নিত্যদিন এ সংকট মোকাবিলা করতে হয়। প্রতিদিনের ব্যবহার্য পানি ছাড়াও নির্মাণকাজের জন্য তাদের দূরদূরান্ত থেকে সশস্ত্র পাহারা দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ব্যাটালিয়ন ব্যান ইঞ্জিনিয়ারের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার লে. কর্নেল তানভীর বলেন, ‘আমরা যখন রাস্তার কাজ করি তখনো পানির জন্য কষ্ট করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে রাস্তার কাজ করতে হয়। আমাদের সৈনিকরা এখানে অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে দেশের জন্য কাজ করছেন। কাজ করার সময়ও সশস্ত্র পাহারা বসাতে হয়।’

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতায় বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা। এর অধিকাংশই আফ্রিকার দেশ। ইতোমধ্যে আফ্রিকার আইভরি কোস্ট, সিয়েরা লিয়ন, দারফুর, রুয়ান্ডা, উগান্ডা, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, সোমালিয়া, মোজাম্বিক, হাইতি, কসোভো, ইথিওপিয়া, লাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এখনো আফ্রিকার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ মালি, কঙ্গো, ওয়েস্টার্ন সাহারা, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, দক্ষিণ সুদানে জাতিগত সংঘাতের কবল থেকে মানুষ বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। দক্ষিণ সুদান শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ১ হাজার ৬২০ জন শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৪১৪, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২০৩ ও বিমানবাহিনীর তিনজন সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে সেখানে ১৭ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের অপরিসীম ত্যাগ, কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।

সর্বশেষ খবর