সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা
গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা

শুধু বসতভিটা উঁচু করেই কমানো সম্ভব চরাঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

শুধু বসতভিটা উঁচু করেই কমানো সম্ভব চরাঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি

প্রতি বছর বন্যা ও নদী ভাঙনে শেষ সম্বল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয় অসংখ্য মানুষ। সকালে যিনি জমিদার, বিকালেই নদী ভাঙনে হয়ে যান ফকির। বন্যার কারণে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে কখনই উঠে দাঁড়াতে পারে না চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ। অথচ বন্যাপ্রবণ এলাকায় শুধু বসতভিটা উঁচু করেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। আর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ করার মাধ্যমে দূর করা যায় নদী ভাঙন।

জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস-২০২২ উপলক্ষে গতকাল ‘উত্তরাঞ্চলের চরের মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলা ও জীবনমান উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। এডব্লিউও ইন্টারন্যাশনাল ও বিএমজেড-এর সহযোগিতায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের কনফারেন্স হলে এ আলোচনার আয়োজন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ও গণ উন্নয়ন কেন্দ্র। অনুষ্ঠান আয়োজনে আরও সহযোগী হিসেবে ছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এটিএন বাংলার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর কেরামত উল্লাহ বিপ্লবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান এনডিসি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন, গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম আবদুস সালাম, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক কুন্তলা চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের যুগ্ম সম্পাদক আবু তাহের, বার্তা সম্পাদক কামাল মাহমুদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুব্রত পাল চৌধুরী প্রমুখ। প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, চর এলাকায় ভিটি উঁচুকরণ নিয়ে অনেক দিন ধরে প্রকল্প চলছে। এটার সফলতা সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ওয়াকিবহাল আছেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, চর এলাকায় প্রতিটি বাড়ির ভিটি বন্যার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতার ওপরে করার জন্য। এতে বন্যার কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষের স্থানান্তরের বিষয়টি এড়ানো যায়। মানুষ গবাদিপশু ও শস্য নিয়ে ঘরেই থাকতে পারে। এটা চলমান থাকলে অবশ্যই চর এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়বে। দারিদ্র্যমুক্ত হবে। একই সঙ্গে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বৈঠক করে চরগুলোকে বেড়িবাঁধের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে পানির গতির জন্য ভূমিধস বা ভাঙন বন্ধ করতে পারব। এ ছাড়া দুর্যোগ হিসেবে ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কোড অনুযায়ী সাড়ে ৭ রিখটার স্কেল স্ট্যান্ডার্ড ধরে এখনকার ভবনগুলো হবে। যেসব স্থাপনা বেশি পুরনো সেগুলো ভেঙে বিল্ডিং কোড অনুযায়ী নতুনভাবে তৈরি করব। ভূমিকম্পের সময় গ্যাস ও বিদ্যুৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধের ব্যবস্থা করতে কাজ চলছে। অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি হ্রাসেও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহনীয় হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডেল্টা প্ল্যান দিয়েছেন। অনেক বড় বাজেট। ছয়টি হটস্পট। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ সব দুর্যোগে সহনীয় রাষ্ট্র হয়ে যাবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উত্তরাঞ্চলের চরের মানুষের জীবনযাপন চিত্র তুলে ধরেন চরাঞ্চল গবেষক ও গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম আবদুস সালাম। একই সঙ্গে গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রকল্পের মাধ্যমে চরাঞ্চলের মানুষের ভিটেমাটি উঁচু করে কীভাবে তাদেরকে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছেন তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, আমরা গণ উন্নয়ন কেন্দ্র ৪০টি পরিবারের জন্য এমন একটি প্রকল্পের নকশা করেছি ১৪৪.৪২ শতক জমিতে। ঘরবাড়িগুলো ৮ ফুট উঁচু। সোলার লাইট দিয়েছি। টয়লেট, টিউবওয়েল, নারী ও কিশোরীদের জন্য ১০টি গোসলখানা, পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মোট খরচ ২০ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। গড়ে প্রতি পরিবারের পেছনে ব্যয় ৫০ হাজার টাকা। এটা খুব বেশি নয়। এ পরিবারগুলোর বন্যায় যে ক্ষতি হয়, সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে সাহায্য দিতে হয়, তা ৫০ হাজার টাকার চেয়ে অনেক বেশি।

ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের সব কাজ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের ১৪৭টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে এ রকম একান্তভাবে কাজ করার সুযোগ আমরা পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে। মানুষের বাসস্থানের অভাব দূর করতে ভূমিহীনদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের হাতে এখন প্রস্তুতি নেওয়ার মতো আগাম তথ্য থাকে। এ জন্য ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের চেয়ে সামাজিক দুর্যোগ এখন বেশি ক্ষতি করছে। সামাজিক ঝুঁকি সামলাতে আমাদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কামরুল হাসান এনডিসি বলেন, নদী ভাঙনে শেষ সম্বল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে ভূমিহীন, অসহায় মানুষদের দুর্যোগ সহনীয় ঘর করে দিচ্ছেন। আমরা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থান করছি। ভূমিকম্প নিয়েও আমরা কাজ করছি। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কারণে প্রতি বছর অনেক মানুষ মারা যেত। সেটা এখন অনেক কমিয়ে আনতে পেরেছি।

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মাহবুবা নাসরিন বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত স্থায়ী আদেশাবলিতে যে বিষয় রয়েছে তা বহুদিন পরিবর্তন হতে দেখিনি। এ পর্যন্ত তিনবার স্থায়ী আদেশাবলি হালনাগাদ করা হয়েছে। দুর্যোগের ইতিহাসের মতো দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ইতিহাস দীর্ঘ নয়।  দেশের সব এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান একরকম নয়। তাই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার ব্যবস্থাপনা এবং চরাঞ্চলের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অবশ্যই আলাদা হতে হবে। বন্যা, নদী ভাঙন এলাকায় দুর্যোগ সহনশীল ঘর তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ঘরবাড়ি তৈরি করতে গিয়ে সেসব এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট করা যাবে না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বলেন, ২০২০ সালের বন্যার সময় ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে পারিনি। গবাদিপশু রেখে তারা আসতে চায় না। তখন ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাইলট প্রকল্প হিসেবে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়ার দুটি উপজেলা, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরের প্রায় ৬০০ ঘরের ভিটা উঁচু করার পদক্ষেপ নেই। পাইলটিং আকারে প্রকল্পটি জমা দিয়েছি। অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে। খরচ হবে ৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘরের মালিকের অংশীদারিত্ব থাকায় খরচ কিছুটা কম হবে। আমরা গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের বানানো ঘরগুলো পরিদর্শন করেছি। খুবই টেকসই হয়েছে।

নঈম নিজাম বলেন, ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন দুর্যোগপ্রবণ এলাকা পরিদর্শন করেছি। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে কম্বল বিতরণ করতে গিয়ে দেখেছি সেসব এলাকায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। পরিবর্তন হচ্ছে। চরাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি শহরের মানুষের ভূমিকম্প ও অগ্নিকান্ড ঝুঁকি নিয়েও ভাবা দরকার। এটা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়।

সর্বশেষ খবর