মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ

নেতৃত্বে আস্থায় সফল নারী

শীর্ষ পদসহ বেছে নিচ্ছেন চ্যালেঞ্জিং পেশা

জিন্নাতুন নূর

নেতৃত্বে আস্থায় সফল নারী

নারীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে গেছে বহুদূর। রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রীড়া, মহাকাশ, বিজ্ঞান গবেষণা- কোথায় নেই নারীর পদচারণ! এমনকি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। হিসাব বলছে, দেশে নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হারও কমেছে। নারীর এ ধারাবাহিক সাফল্যে পেশাভিত্তিক ও চ্যালেঞ্জিং বিভিন্ন খাতে ক্রমেই তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনসহ নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করায় এরই মধ্যে নারীর কর্মদক্ষতার ওপর প্রসাশনসহ সরকারি-বেসরকারি খাতে আস্থা তৈরি হয়েছে, যা নারীদের আরও নতুন নতুন খাতে যুক্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করছে। এ অবস্থার মধ্যে আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘টেকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। মার্কিন অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের ২০২১ সালের বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান ছিল ৪৩তম। বিশ্বের রাজনীতি, মানবসেবা, ব্যবসা ও গণমাধ্যমে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসা প্রভাবশালী নারীদের মধ্য থেকে ১০০ জনকে নির্বাচিত করে ফোর্বস এ তালিকা প্রকাশ করে। আশার কথা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পেয়েছেন শিরীন আখতার। এর আগে তিনি ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এক মাসের বেশি ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করেন। শিরীন আখতারই প্রথম নারী, যিনি কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন। এ ছাড়া ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন হুমায়রা আজম। দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম কোনো তফসিলি বেসরকারি ব্যাংকের নারী এমডি। দেশের ফুটবলে নতুন ইতিহাস লিখেছেন সালমা আক্তার। প্রথম নারী রেফারি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন প্রিমিয়ার লিগে। গত বছর ১৬ আগস্ট কমলাপুর শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আরামবাগ-উত্তর বারিধারা ম্যাচে সহকারী রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সালমা। এ ছাড়া দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী বনরক্ষীর তালিকায় নাম লিখেছেন দিলরুবা আক্তার মিলি। এরই মধ্যে সিলেটের মেয়ে মাহজাবিন হক যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি নারী, যিনি নাসায় কাজ করছেন।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী ‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’-এর শীর্ষ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের তিন নারী। তাঁরা হলেন লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান ড. ফেরদৌসী কাদরী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সায়মা সাবরিনা। এর মধ্যে গত বছর এশিয়ার নোবেল খ্যাত র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী। বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকায় কলেরা, টাইফয়েড ও বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঠেকাতে তাঁর গবেষণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

বিভিন্ন হিসাব বলছে, গত কয়েক দশকে শিক্ষা, শ্রমবাজার, কৃষি এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আর শ্রম জরিপের তথ্যে দেশের মোট কর্মজীবী নাগরিকের ৩৮ শতাংশই নারী। শ্রমজীবী নারীর সিংহভাগই তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত। এর বড় একটি অংশ নিয়োজিত কৃষি খাতেও। সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। আবার গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স ২০২১-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম। প্রশাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরেও বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব হিসেবে উল্লেখযোগ্য নারী কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন। স্থানীয় প্রশাসনেও নারী জেলা প্রশাসকরা সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বিচার বিভাগে আছে নারীর সরব উপস্থিতি। উচ্চ আদালতেও এখন বেশ কয়েকজন নারী বিচারপতি দায়িত্ব পালন করছেন। আবার বাংলাদেশ পুলিশের মোট জনবলের ৭ দশমিক ৯ শতাংশই নারী। বাহিনীতে নারী পুলিশের সংখ্যা এখন ১৫ হাজারের ওপরে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও মন্ত্রিসভায় আর চারজন নারী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হিসেবে এখন দায়িত্বে রয়েছেন ফরিদা ইয়াসমিন। দেশে পোশাককর্মীর প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারী ২৪ লাখ ৯৮ হাজার জন। এ ছাড়া জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, ১৯৯১ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে যান। প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া সেবা খাতে প্রায় ৩৭ লাখ নারী কর্মরত। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। এর সঙ্গে সংসারের ভিতরের ও বাইরের কাজের মূল্য ধরলে তাদের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর