বুধবার, ৯ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ডিঙ্কাদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ

দক্ষিণ সুদানের জনগোষ্ঠী

শিমুল মাহমুদ, দক্ষিণ সুদান থেকে ফিরে

ডিঙ্কাদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ

দক্ষিণ সুদানের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ডিঙ্কাদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কোনো শেষ নেই। তাদের বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘদেহী মানুষ। ডিঙ্কা পুরুষের গড় উচ্চতা ৬ ফুট ছুঁইছুঁই। উচ্চতার কারণে বৈশ্বিক বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায়ও ঠাঁই করে নিয়েছেন একাধিক ডিঙ্কা সদস্য। কালো দীর্ঘকায় গড়নের এ জনগোষ্ঠী দক্ষিণ সুদানের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ। সম্প্রতি দেশটিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্টগুলো পরিদর্শনকালে ডিঙ্কা সম্প্রদায়ের অনেক সদস্যের দেখা মেলে। রাজধানী জুবার সর্বত্র নানা পেশায় জড়িত এসব দীর্ঘদেহী মানুষ।

অনেকটা যাযাবার শ্রেণির জীবনাচরণে অভ্যস্ত ডিঙ্কা জনগোষ্ঠীর কোনো সংঘবদ্ধ কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নেই। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতার লড়াইয়ে কোনো সরকারের সঙ্গে তারা নেই। নিজেরা বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট দলবদ্ধ-জীবন যাপন করে।

সর্বশেষ ২০০৮ সালে অবিভক্ত সুদানের আদমশুমারি অনুসারে ডিঙ্কা সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। তবে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে তাদের কয়েক লাখ মানুষ মারা যায়। বর্তমানে ডিঙ্কারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ এবং তারা দক্ষিণ সুদানের বৃহত্তম জাতিগত উপজাতি। ডিঙ্কা সম্প্রদায় নিজেদের মুওনিজ্যাং কিংবা জেয়েং হিসেবেও পরিচয় দেয়। মূলত নীলনদের উপত্যকা ও আফ্রিকান গ্রেট লেক অঞ্চলের বসতিহীন কৃষিজীবী মানুষ ডিঙ্কারা নিলোটিক ভাষায় কথা বলে। অনেকে আবার আরবি ভাষাভাষী। ডিঙ্কারা বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত তাদের অস্বাভাবিক দৈহিক উচ্চতার জন্য। তাদের বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ বিবেচনা করা হয়। গবেষক রবার্টস ও বেইনব্রিজ কয়েক বছর আগে তাদের এক গবেষণায় ডিঙ্কা জাতিগোষ্ঠীর নমুনা পরীক্ষায় গড় উচ্চতা পেয়েছেন ১৮২ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার বা ৫ ফুট ১১ দশমিক ৯ ইঞ্চি। তবে ওই গবেষণার পর আজকের ডিঙ্কা পুরুষের উচ্চতা কিছুটা কমেছে। সম্ভবত অপুষ্টি এবং জাতিগত দ্বন্দ্বের খুনোখুনিতে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মৃত্যুর কারণে তাদের গড় উচ্চতা কিছুটা কমেছে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ইথিওপিয়ার যুদ্ধ শরণার্থীদের মধ্যে ডিঙ্কা পুরুষদের ওপর একটি নৃতাত্ত্বিক জরিপে ১৭৬ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ৯ দশমিক ৪ ইঞ্চি) গড় উচ্চতা পাওয়া গেছে। তুলনামূলক ঐতিহাসিক উচ্চতার তথ্য ও পুষ্টির অন্যান্য গবেষণায় ডিঙ্কা জনগোষ্ঠীকে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সম্প্রতি দক্ষিণ সুদান সফরকালে ডিঙ্কা জনগোষ্ঠীর এসব দীর্ঘদেহী মানুষের অনেককে দেখা গেছে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে নানা পণ্য বিক্রি করতে। তবে তাদের মূল জীবিকা কৃষিকাজ ও গবাদি পশু পালন। বিশেষ করে গরুর পাল নিয়ে দিনের পর দিন মাঠে থাকে তারা। তবে এই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রচুরসংখ্যক মানুষ প্রবাসে বসবাস করে। ডিঙ্কারা বেশির ভাগই নীলনদের ধারে বাস করে, জোংলেই থেকে রেঙ্ক পর্যন্ত, বাহর এল গজল অঞ্চলে, আপার নীলনদ (তিনটি প্রদেশের মধ্যে দুটি, যেটি আগে দক্ষিণ সুদানে অবস্থিত ছিল) এবং দক্ষিণ সুদানের পার্শ্ববর্তী আবেই এলাকায় বসবাস করে। এ আবেই এখন সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যবর্তী বিশেষ শাসিত অঞ্চল। এখানে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫ শতাধিক সদস্য শান্তিরক্ষী হিসেবে মোতায়েন হতে যাচ্ছে।

ডিঙ্কা সম্প্রদায়ের জীবিকা মূলত ঐতিহ্যগত কৃষি ও পশু পালনের ওপর নির্ভর করে। গবাদি পশু পালন তাদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক গৌরব। ডিঙ্কারা গবাদি পশু লালনপালন করে বাণিজ্যিক বা মাংসের উদ্দেশ্যে নয়, বরং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পারিবারিক আচার, দুধ সংগ্রহ, খাদ্য, বিয়ে এবং কনেপক্ষকে ‘যৌতুক’ হিসেবে দেওয়ার জন্য। বিশাল গুরুর পাল থাকলেও এগুলো সাধারণত জবাই করা হয় না। দক্ষিণ সুদানে মূলত দুই ঋতু। শুষ্ক মৌসুমে ডিঙ্কারা তাদের গবাদি পশুকে নদী, তৃণভূমিতে নিয়ে রাখে। তবে বর্ষাকালে বন্যা এবং জল এড়াতে উচ্চতর স্থানে তাদের নিয়ে যায়। ডিঙ্কা সম্প্রদায় গরম জলবায়ুতে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট কষ্টসহিষ্ণু। খাবারের সংকট এবং অনভ্যস্ত চর্চার কারণে তারা সাধারণত দিনে শুধু একবার খাবার খায়। আগুনের চারপাশে বসে সন্ধ্যায় খাবার খায়। ডিঙ্কাদের প্রধান খাদ্য দুধ, শাকসবজি ও মাছ। কৃষি ও পশু পালন ডিঙ্কা উপজাতির প্রধান পেশা হলেও ডিঙ্কা মহিলারা কুমড়া, কাসাভা, ভুট্টা এবং তিলের মতো অনেক শস্য ও শাকসবজি উৎপাদন করেন। ডিঙ্কা পুরুষরা পশুর পালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ডিঙ্কা সম্প্রদায়ের কোনো পরিবারে একটি কন্যাসন্তান থাকাকে মেয়েটির পরিবারের জন্য সুখ এবং সম্পদের একটি পরিমাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ পরিবারে যত বেশি মেয়ে থাকবে, সে পরিবার তত বেশি ধনী ও সমৃদ্ধ হবে। যখন একটি ছেলে একটি মেয়েকে বিয়ে করে তখন মেয়েটির পরিবারকে যৌতুক হিসেবে অনেক টাকা অথবা অনেক গরু দিতে হয়।

সর্বশেষ খবর