সোমবার, ১৪ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

আবাস হারিয়ে হুমকিতে বন্যপ্রাণী

গাছ কাটা, অজ্ঞতা, খাদ্য সংকট, বনে পর্যটকদের হই-হুল্লোড়ে সমস্যা বাড়ছে

জিন্নাতুন নূর

আবাস হারিয়ে হুমকিতে বন্যপ্রাণী

দেশে আশঙ্কাজনকহারে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে আসছে। সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কেটে ফেলায় হুমকিতে পড়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। আবাসস্থল হারিয়ে অনেক বন্যপ্রাণী বাধ্য হয়ে লোকালয়ে চলে আসছে। আর মানুষের কাছাকাছি চলে আসায় তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বন বিভাগ বা ব্যক্তি মালিকানায় সারা দেশে বন্যপ্রাণীদের নিজেদের লুকানো বা আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো জায়গা এখন নেই। ফলে প্রায় সময়ই হাতি, বাঘ, নীলগাই, বনরুইসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী হত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইন ও পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এ নিরীহ প্রাণীদের সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।

২০২০ সালের গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ-এর প্রতিবেদন বলছে, গত সাত বছরে সাড়ে ৩ লাখ একরের বেশি বনভূমি উজাড় হয়েছে। এতে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। আর বন অধিদফতরের তথ্যে, ২ লাখ ৫৭ একর বনভূমি বেদখল হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার আইইউসিএনের সর্বশেষ সমীক্ষা বলছে, দেশ থেকে এরই মধ্যে ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে আছে ১ হাজার ৮২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে বনে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে চলে আসছে। কিছুক্ষেত্রে লোকালয়ে ছুটে আসতে গিয়ে তারা রেল বা সড়ক পথে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া বনের ভিতর অধিক সংখ্যক মানুষ প্রবেশ করায় বনের নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে প্রাণীদের আবাসস্থল। আবার সচেতনতার অভাবেও অনেকে বন্যপ্রাণী নির্বিচারে হত্যা করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে একটি প্যারাবন থাকে, কিন্তু সেখানেও বন্যপ্রাণীদের জন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয় আর নেই। এখন গ্রামে বা বনে কোনো লতাপাতা-ঝোপঝাড় নেই। আর এটি বন্যপ্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম                কারণ। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের যুগ যুগ ধরে দ্বন্দ্ব থাকলেও মানুষ আগে বন্যপ্রাণীকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু এখন মানুষের কাছে কোনো বন্যপ্রাণী চলে এলে তাকে নির্যাতন বা হত্যা করার ব্যাপারে মানুষ বেশি আগ্রহী। আর যে বন্যপ্রাণীগুলোকে হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হয়, দেখা যায় যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এরা নিরীহ প্রাণী। দেশে যে সাপগুলো মেরে হত্যা করা হয়েছে তার বেশির ভাগই মানুষকে কামড়ায় না। ৮০ শতাংশ সাপের কামড়ে সামান্য ব্যথা ছাড়া কোনো সমস্যা হয় না। শুধু আতঙ্ক ও ভুল চিন্তার কারণে এ সাপগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। একইভাবে শিয়াল ও মেছোবিড়াল জাতীয় প্রাণীকে ‘বসতভিটার হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলে’- এ ভুল তথ্য থেকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে, এ প্রাণীগুলো বছরে দু-একদিন বাড়ির হাঁস-মুরগি খায়। এ ছাড়া মানুষের অজ্ঞতার  জন্যও বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব হুমকিতে আছে। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহির উদ্দিন আকন বলেন, আমাদের এ ইউনিটটি প্রকল্পের আওতাধীন। বন্যপ্রাণী রক্ষায় এরই মধ্যে ইউনিটটি প্রসংশা পেলেও একে রাজস্ব খাতে নেওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। যদি এটি সম্ভব হয় তবে বর্তমানে আমরা যা কাজ করছি তার ১০ গুণ বেশি কাজ করা সম্ভব হবে।

শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় প্রায়ই বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে মানুষের হাতে ধরা পড়ছে লাউয়াছড়ার অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। মাঝে-মধ্যে বন্যপ্রাণীগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বেশির ভাগ সময় তা হয় না। লাউয়াছড়ার ভিতর দিয়ে বয়ে চলা রেল ও সড়ক পথেও মারা যাচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী। এ ছাড়া এসব এলাকায় অতিমাত্রায় পর্যটকদের আগমন, বনের গভীরে পর্যটকদের হই-হুল্লোড়, বনের ভিতর বেপরোয়া যান চলাচলে নিরাপদ আবাসস্থলের খোঁজে বন্যপ্রাণীরা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। আবার এ বনের ভিতর থাকা সংঘবদ্ধ চোরচক্র নির্বিচারে বনের গাছ উজাড় করায় বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংকট চরম আকারে দেখা দিয়েছে।

আবার প্রায়ই লোকালয়ে হাতি ঢুকে পড়ার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতির আবাসভূমিতে মানুষ ঢুকে পড়ায় হাতির জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার বনাঞ্চলের হাতিগুলো স্থায়ীভাবে বসবাস করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গারা সেখানে বসতি গড়ে তোলায় হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। শেরপুর বনাঞ্চলে অনেক হাতি ভারতের মেঘালয় থেকে খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশের দিকে চলে আসে। কিন্তু এক দশকে বন বিভাগের বহু জমি মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় হাতির এ বিচরণক্ষেত্র এখন আর হাতির জন্য নিরাপদ না। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডু পাহাড় একটি সময় বন-জঙ্গলে ঘেরা ছিল। সেখানে প্রতিনিয়ত বিচরণ করত বাঘ, বানর, হরিণ, বনবিড়াল, ভালুকসহ বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত সাপ। কিন্তু এ এলাকায় জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নির্বিচারে পাহাড় ও গাছ কাটায় বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল হারিয়ে ফেলছে। বানর ও হরিণসহ বেশ কিছু প্রজাতি পাহাড়ে থাকলেও খাদ্যসংকটে তারা প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসছে। কয়েক দশক আগেও মধুপুর বনে চিতা বাঘ, হাতি, বন্য মহিষের দেখা মিলত। কিন্তু বনভূমি উজাড় হওয়ায় এ বনে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমতে শুরু করে। বন বিভাগের ভাষ্যে, বনের জমি দখল করে আদিবাসীদের ঘর নির্মাণ ও বন্যপ্রাণী হত্যা করায় বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমতে শুরু করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় বাংলাদেশে যে আইন করা হয়েছে তা বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক কঠোর। কিন্তু এ আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ নেই। আবার বনভূমি দখলমুক্ত করা, ফাঁদ ও বিষটোপ দূর করা এবং বন্যপ্রাণী হত্যায় জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু স্থানীয় এলাকাবাসী এবং রাজনীতিকদের চাপ এবং মাঠপর্যায়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সংকটের জন্য বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর