মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা
মন্ত্রিসভার বৈঠক

আমদানি পর্যায়ে নিত্যপণ্যের শুল্ক কমানোর নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সার্বিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভোজ্য তেল, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ভ্যাট কমানোর নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং সচিবালয় থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।

খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, বৈঠকে এভিডেন্স (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক (ছুটি, পেনশন ও বিশেষাধিকার) আইন, পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাড়ি (সম্পূরক বিধান) আইন এবং জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

দাম সহনীয় রাখতে রবিবার আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে ভোক্তা পর্যায়ে নিত্যপণ্যের ভ্যাট তুলে দেওয়াসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়েছিল জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, গতকালের বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন এবং খুব স্ট্রংলি ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন। ভোজ্য তেলের রিটেইলার (খুচরা) পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী এসআরওতে সই করেছেন বলে জানিয়েছেন। আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। আমদানি পর্যায়ে যে ভ্যাট আছে সেটা যথাসম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য এনবিআরকে বিবেচনা করার জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে কমালে আমাদের ধারণা যে এটার একটা সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, শুধু ভোজ্য তেল নয়, চিনি বা যেগুলো বেশি প্রয়োজনীয় সেগুলোর ক্ষেত্রে ভ্যাট কমাতে বলা হয়েছে। যেটা খুবই ক্রাইসিসে থাকবে সেটার ক্ষেত্রে একদম কম পর্যায়ে নিয়ে আসা। সম্ভাব্য লোয়েস্ট একটা সিলিংয়ে যাওয়া। ভ্যাট যথাসম্ভব সহনীয় একেবারে লোয়েস্ট লেভেলে নেওয়া যায় কি না সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে এনবিআরকে যথা শিগগিরই বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।

এভিডেন্স (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট : মামলার বিচারে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের সুযোগ রেখে সাক্ষ্য আইন সংশোধনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, গত কভিডের পর থেকে অনলাইনে মামলা মোকদ্দমা চলছিল। এর ফলে সাক্ষ্য-প্রমাণ সব অনলাইনেই আসছিল। কিন্তু আমাদের এভিডেন্স অ্যাক্টে আবার এ রকম ডিজিটাল এভিডেন্সের সরাসরি কোনো বিধান ছিল না। কেউ যদি মামলায় হেরে যেত, সে যদি আপিল করত ওপরের কোর্টে, সেক্ষেত্রে আইনি কিছু জটিলতা হওয়ার সুযোগ ছিল। এটা অনেক দিন ধরেই আলোচনায় ছিল। এখন থেকে ডিজিটাল যে এভিডেন্স, সেগুলোও গ্রহণ করা হবে। কেউ যাতে ভুয়া বা জাল সাক্ষ্য-প্রমাণ ডিজিটাল মাধ্যমে হাজির করতে না পারে, আদালত যদি মনে করে যে কোথাও আপত্তিজনক কিছু আছে, অথবা কেউ যদি আপত্তি তোলে, তাহলে ওই সাক্ষ্য-প্রমাণের ফরেনসিক পরীক্ষা করা যাবে। এটা করলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে। কেউ একটা ম্যানুপুলেটেড এভিডেন্স দিল, এটা কিন্তু বাঁচার কোনো উপায় নাই। কারণ ফরেনসিক করলেই ধরা পড়ে যাবে। বিশেষ করে ডকুমেন্টের ফরেনসিক কিন্তু দুই চার মিনিটেই করা যায়। একটু সময় লাগে ভিডিওর ক্ষেত্রে, তাও খুব বেশি সময় লাগে না। আমাদের পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি আছে দেশে। খুব হাই টেকনোলজি আছে। এগুলো বিভিন্ন জায়গায় সরকার সুবিধামতো ছড়িয়ে দিয়ে যে ডিজিটাল সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হবে সেগুলো যদি কোর্ট বা কোনো পক্ষ মনে করে আপত্তি আছে, তাহলে ফরেনসিক করে নেবে। টুইস্ট করার কোনো উপায় নেই। কেউ যদি টুইস্ট করে, তাহলে আমাদের দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যের বিষয় আছে আর ডিজিটাল অ্যাক্টেরও ৫৭ ধারা আছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারায় ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মামলায় বাদীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার যে সুযোগ রয়েছে, সংশোধনে পরিবর্তন আনা হয়েছে জানান আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভিকটিমকে জেরা করার ক্ষেত্রে শালীনতা বজায় রাখতে হবে। কোন জাতীয় প্রশ্ন প্রয়োজন সেটা কোর্ট ঠিক করে দেবে।

বিশেষ ভাতা পাবেন প্রধান বিচারপতি : অবসরের পর প্রধান বিচারপতির জন্য মাসে ৭০ হাজার টাকা বিশেষ ভাতার বিধান রেখে একটি আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটি অধ্যাদেশ আকারে ছিল, এখন আইনে পরিণত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে দু-একটি বিষয়ে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তাঁর জীবদ্দশায় গৃহ সহায়ক, গাড়িচালক, নিরাপত্তা সেবা, সাচিবিক সহায়তা এবং অফিস কাম রেসিডেন্স রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৭০ হাজার টাকা অবসরোত্তর বিশেষ ভাতা পাবেন।

আরেকটা জিনিস প্রস্তাব করা হয়েছে যে, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে, এটা ক্যাবিনেট আলোচনা করে বলেছে যে, এটা আইনের মধ্যে থাকার দরকার নেই। এটা সরকার মনে করলে এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে তাদেরকে দিতে পারবে। এটা আইনে আনা যাবে না। কারণ অন্য কোনো দেশের আইনে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে অবসরের পর নিরাপত্তা কতদিন দিতে হবে, এটা আইনে নেই। সে জন্য সরকার মনে করে যে, যদি কারও ক্ষেত্রে সেনসিটিভিটি থাকে, সেক্ষেত্রে সরকার নির্বাহী আদেশ দিয়ে তাকে একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত নিরাপত্তা দেবে। তিনি আরও বলেন, কোনো বিচারক অবসর গ্রহণকালে ছুটি পাওনা সাপেক্ষে ১৮ মাসের ছুটি নগদায়নের সুবিধা পাবেন, যেটা সরকারি কর্মচারীরা পায়। এটা সুপ্রিম কোর্টের জাজদের বেলায় ছিল না। এখন যদি উনাদের ছুটি পাওনা থাকে, তাহলে উনারাও পাবেন।

পরিত্যক্ত হবে যুদ্ধাপরাধীর সম্পত্তি : যুদ্ধাপরাধীর বাড়ি বা সম্পত্তি আদালত বাজেয়াপ্ত করলে তা পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত করার বিধান রেখে ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাড়ি (সম্পূরক বিধান) আইন, ২০২২’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। একই সঙ্গে পরিত্যক্ত সম্পত্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আইনে। এ বিষয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এটা ১৯৮৫ সালের অধ্যাদেশ। আমাদের দেশের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হচ্ছে যারা ১৯৭১ সালে দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে, তখন বিধিবিধান করে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হ্যান্ডেল করা হতো। সেটা পরবর্তী সময়ে ১৯৮৫ সালে একটি অর্ডিন্যান্স করা হলো। যেহেতু এটা সামরিক শাসনামলের অর্ডিন্যান্স সে জন্য হাই কোর্টের আদেশ অনুযায়ী নতুন আইন হিসেবে আনতে হচ্ছে। এতে ছোটখাটো দু-একটি সংশোধন আনা হয়েছে। খন্দকার আনোয়ার বলেন, যুদ্ধাপরাধীর মামলায় যদি কেউ দণ্ডিত হতো, কোর্ট যদি তার জমিজমা-সম্পত্তি সিজ করে নেয়, তবে সেটাও পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে পড়বে, যেটা আগে ছিল না। আদালত কর্তৃক যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণিত বা ঘোষিত কোনো ব্যক্তির বাড়ি বা সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে সংযুক্ত বা বাজেয়াপ্ত করে তবে তা পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন বাড়িগুলোর যে মূল্য হয়েছে, মন্ত্রী, সচিবসহ বিভিন্ন বড় বড় অফিসাররা গুলশান-বনানীতে যেসব বাড়িতে থাকেন, এগুলো ৯৯ শতাংশই পরিত্যক্ত সম্পত্তি। এসব বাড়ির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। এক-একটি বাড়ির দাম কয়েক শ কোটি টাকাও হবে।  সে জন্য আইনে একটি সংশোধনী আনা হয়েছে। আগে ছিল, সরকার এই বাড়িগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। এখন এখানে সংশোধনী আনা হয়েছে, সরকারপ্রধান এটা করবেন। এসব বাড়ির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন সরকারপ্রধান।

আইন হচ্ছে জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনায় : সরকারিভাবে সংগ্রহ করা জাকাতের অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি আইন হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে একটি জাকাত বোর্ড করা হবে। সেই বোর্ডের অধীনে প্রয়োজনীয় সদস্য নিয়ে একটি কমিটি করা হবে, তারা জাকাত সংগ্রহ করবে। সুরা তওবায় জাকাতের যে ৭টি ক্ষেত্রের কথা বলা আছে, সেভাবেই সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করবে। এটাই এ আইনের মূল কথা। জাকাত বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন ধর্মমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, বোর্ডে সদস্য থাকবে ১০ জন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও কমিটি করে দেওয়া হবে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য। এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি, বিদেশি যে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা তফসিলি ব্যাংকের জাকাত ফান্ডেও অর্থ জমা দিতে পারবে। এখানে আরেকটা প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়েছিল যে সরকার ছাড়াও অনেক ব্যাংক জাকাত আদায় করে, তাদের কাছ থেকে একটা হিসাব নিতে হবে। সেটাতে সরকার সম্মতি দেয়নি। কে কীভাবে জাকাত আদায় করল না করল, সেটা আমাদের বিষয় না। কারণ জাকাতটা ব্যক্তিগত বিষয়, ব্যক্তিগত ইবাদত। কারও যদি জাকাত দেওয়ার ক্ষমতা থাকে, সেটা ফরজ এবং তাকে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিয়ে জাকাত আদায় করতে হবে।

সর্বশেষ খবর