বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

ভূমধ্যসাগরে ১১ ঘণ্টা ভেসে যেভাবে বেঁচে ফিরলেন সামিউল

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

ভূমধ্যসাগরে ১১ ঘণ্টা ভেসে যেভাবে বেঁচে ফিরলেন সামিউল

উত্তাল সাগরের বুকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে স্বপ্নের দেশ ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ তিন বন্ধুর একজন হলেন ফরিদপুরের নগরকান্দার কাইচাইল ইউনিয়নের সামিউল শেখ (২১)। সম্প্রতি তিনি প্রাণে  বেঁচে ফিরে এসেছেন দেশে। সাত দিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে তিনি এখন বাড়িতে। তার অন্য দুই বন্ধু মইন ও নাজমুল সাগরে ডুবে মারা গেছেন। তাদের সঙ্গে আরও ২৯ জনের সলিল সমাধি হয়েছে ভূমধ্যসাগরে। সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে তাকে। এদিকে, মানব পাচারে জড়িত প্রধান দুই আসামি এখনো লিবিয়ায় রয়েছেন। তাদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবি করেছে ভিকটিমদের পরিবার। এ বছরের ২২ জানুয়ারির দিকে ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌযানে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ঠান্ডায় জমে মারা যান সাতজন। এ ঘটনার মাত্র পাঁচ দিন পর ২৭ জানুয়ারি তাদের ৩৫ জনকে একইভাবে ইতালির উদ্দেশে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পাঠানো হয়। যাদের মধ্যে সামিউলসহ মাত্র সাতজনের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। তাদের এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া ভয়ঙ্কর ‘মানব পাচারকারীদের দালাল’ শওকত চৌধুরী ও রাসেল মিয়া এখনো গ্রেফতার হননি। সম্পর্কে তারা মামাতো-ফুফাতো ভাই। থাকেন লিবিয়াতে।

সামিউল শেখ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার দক্ষিণ কাইচাইল গ্রামের ইউনুস শেখের ছেলে। তার দুই বন্ধু বাবুর কাইচাইল গ্রামের ফারুক মাতব্বরের ছেলে মইন মাতব্বর ফয়সাল (১৯) ও মাজেদ মিয়ার ছেলে নাজমুল মিয়াসহ (২২) তাদের তিনজনের পরিবার ৩০ লাখ টাকায় তাদের ইউরোপে পাঠাতে দালালের শরণাপন্ন হন। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মৃত্যুপুরীতে।

মানব পাচারকারী চক্রের দালাল রাসেল ও শওকত ঢাকা থেকে গত বছরের ১৭ নভেম্বর বিমানে তাদের তিন বন্ধুকে দুবাই নিয়ে যান। এরপর ১ ডিসেম্বর নিয়ে যান লিবিয়া। সেখানে নিয়ে তাদের ঘরবন্দি করে রাখা হয় প্রায় দুই মাস। সামিউল জানান, যাদের মাধ্যমে আমরা গিয়েছিলাম তারা আমার আত্মীয়। তাই ভাবিনি যে ওরা আমাদের জীবন নিয়ে খেলবে। লিবিয়ায় পৌঁছার পর আমরা ওদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ি। বাইরে বের হতে চাইলে গুলি করার ভয় দেখাত। বাইরে যুদ্ধ হচ্ছে বলত। আবার মালিকের সাতটি পিস্তল আছে, যেগুলো দিয়ে গুলি করে দেবে বলত। সামিউল আরও বলেন, ছোট ওই ঘরে ২০ জনের মতো ছিলাম। সারা দিনে ‘খুবজু’ নামে একটি লম্বা বনরুটি দিত। এ থেকে সকালে অর্ধেক ও দুপুরে অর্ধেক খেতাম। রাতে কখনো কখনো সামান্য ভাত দিত। এরপর তাদের নরসিংদীর মনির শীল নামে মানব পাচার চক্রের আরেক দালালের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মনির তাদের হাতবদল করে অলিদ নামে আরেক দালালের কাছে দেয়। প্রায় দুই মাস বন্দিদশায় থাকার পর ২৭ জানুয়ারি তাদের লিবিয়ার জোয়ারা ঘাট থেকে ইতালির উদ্দেশে একটি স্পিডবোটে তোলা হয়। সামিউল জানান, তাদের প্রথমে বলেছিল মালবাহী জাহাজে নেবে। লাইফ জ্যাকেট এবং শুকনা খাবার দেবে। অথচ, যে স্পিডবোটে তুলেছিল সেখানে ২০ জনের মতো লোক বসতে পারে। অথচ দুজন চালকসহ তাদের ৩৭ জনকে ওই বোটে তোলা হয়। তাদের ভয় দেখিয়ে বোটে উঠানো হয়। প্রায় আট ঘণ্টা চলার পর হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে তাদের স্পিডবোটটি উল্টে ২৯ জন সাগরের পানিতে ভেসে যান। সামিউল বলেন, স্পিডবোটের অন্য পাশ ধরে আমরা আটজন ভাসতে থাকি। এভাবে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর আমার বন্ধু নাজমুল ঢেউয়ের তোড়ে ছিটকে পড়েন। এরপর আমরা সাতজন প্রায় ১১ ঘণ্টা ভাসতে থাকি। তখন একজনের একটি গেঞ্জি ছাড়া আমাদের কারও শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। এ সময় দূরে একটি জাহাজ দেখে আমাদের একজন নরসিংদীর ফারুক একটি লাল গেঞ্জি উঁচু করে দেখাতে থাকেন। জাহাজটি ছিল লিবিয়ার কোস্টগার্ডের। তারা আমাদের দেখতে পেয়ে জাহাজে তুলে বুট দিয়ে লাথি মারতে শুরু করে। ওই জাহাজেই রাশেদুল নামে একজন মারা যায়। তাকে লিবিয়ায় এনে দাফন করা হয়। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার পথে মিসরের দুই চালকসহ ৩৭ জনের মধ্যে বেঁচে ফেরেন ছয়জন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সামিউল ও তার বন্ধুদের নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার খবর প্রকাশ করলে দূতাবাস এ ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) তাদের খুঁজে বের করে। এর পর ২ মার্চ নগরকান্দার সামিউল শেখ, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের ইউসুফ মৃধা, একই জেলার নালিখা গ্রামের ইয়াসিন, বেলাব থানার ফারুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাকির ও মাদারীপুরের ইউনুসকে দেশে ফিরিয়ে আনে। সাত দিন কোয়ারেন্টাইন শেষে ১০ মার্চ তারা বাড়িতে ফেরেন। এদিকে এখনো নিখোঁজদের একজন ফয়সাল মাতব্বর মইনের বাবা ফারুক মাতব্বর গত ৫ ফেব্রুয়ারি নগরকান্দা থানায় এ ঘটনায় ১০ জনকে আসামি করে মানব পাচার আইনে একটি মামলা দায়েরের পর পুলিশ হান্নান মাতব্বর ও তার ছেলে তুহিন মাতব্বর নামে দুই আসামিকে গ্রেফতার করে। সন্দেহভাজন হিসেবে কাজল মাতব্বর নামে আরও একজনকেও গ্রেফতার করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগরকান্দা থানার এসআই পীযূষ কান্তি দে বলেন, এ ঘটনায় বেঁচে ফেরা সামিউল সোমবার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নগরকান্দা সার্কেল) মো. সুমিনূর রহমান বলেন, এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে চার্জশিট দেবে। এরপর তাদের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলে দূতাবাসের মাধ্যমে বিদেশে থাকা আসামিদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর