সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

তিন দিন ছুটির পর যানজট ও গরমে স্থবির রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক

তিন দিন ছুটির পর যানজট ও গরমে স্থবির রাজধানী

তিন দিনের সরকারি ছুটি শেষে গতকাল প্রথম কর্মদিবসে রাজধানীর সড়কে সীমাহীন যানজটের সৃষ্টি হয়। সব ধরনের গাড়ি চলাচল বেড়ে যাওয়ায় সকাল ৭টার দিকেই অনেক এলাকায় যানজট দেখা দেয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে প্রতিটি রাস্তায় তৈরি হয় গাড়ির বিশাল সারি। যানজটের সঙ্গে ভ্যাপসা গরম যোগ হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর জীবনযাত্রা। সকাল থেকে রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, নতুন বাজার, কুড়িল বিশ্বরোড, গুলিস্তান, শাহবাগ, মতিঝিল, মহাখালী ও বনানী এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। যানজট বেশি থাকায় হাতিরঝিলের ওয়াটার বাসে বেশি সংখ্যক যাত্রীকে পারাপার হতে দেখা গেছে। সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়ে। গন্তব্যে যেতে প্রত্যেক যাত্রীকে কয়েক গুণ সময় ব্যয় করতে হয়। তারপরও সকাল থেকে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। শনির আখড়া, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তানসহ রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন অফিসগামী যাত্রীরা। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও গাড়িতে উঠতে না পেরে এবং গরমে যাত্রীরা অস্থির হয়ে পড়েন।

ট্রাফিক পুলিশ বলছে, দীর্ঘদিন পর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। এ ছাড়া সামনে রমজান মাস। ফলে ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ এই মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থান করছে। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের কাজে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও রাস্তায় নামছে। ফলে এ সপ্তাহের শুরু থেকেই রাস্তায় গাড়ির চাপ অনেক বেশি। বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ব্যাপক যানজটের কারণে নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, এবার রমজান মাসে স্কুল খোলা থাকবে। এতে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে। এটা পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। থানার টহল দলগুলোকে প্রত্যেক বড় বড় মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করতে হবে। যে যেখানেই চাকরি করি না কেন কারও দৃষ্টিতে কোনো অনিয়ম বা ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা চোখে পড়লে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাতে হবে। গতকাল রাজধানীর রাজারবাগের বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি সড়কে দিনভর গাড়ির দীর্ঘ জটলায় অসহনীয় হয়ে উঠে জনজীবন। নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরেও সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এদিকে, ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গাড়ির চাপ সামলাতে হিমশিম ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। এ অবস্থায় সড়কে গাড়ির চাপ কমানো ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা সিটিতে পর্যাপ্ত রাস্তা নেই। এর মধ্যে উন্নয়ন কাজের কারণে অনেক সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। ট্রাফিক পুলিশ শুধু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাটাই দেখে। সড়ক দেখে আরেকটা সংস্থা। সড়কে সড়কে বিভিন্ন খোঁড়াখুঁড়ি করছে অন্য সংস্থা। অনেকে সমন্বয়ের কথা বলেন। অথচ, কোনো সমন্বয়েই লাভ হবে না। যানজট কমাতে হলে সড়কে গাড়ি কমাতে হবে। নয়তো সড়ক বাড়াতে হবে। ঢাকা সিটিতে সড়ক এমনিতেই কম। তার ওপর মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। কোথাও কোথাও স্যুয়ারেজের লাইনের কাজ করতে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এসব সড়কে আগে চার লেন দিয়ে গাড়ি চলাচল করত। এখন দুই লেনও চলতে পারে না। তারা আরও বলেন, প্রায় দুই বছর বন্ধের পর পুরোদমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। সবকিছু খুলে দেওয়ায় সব গাড়ি একসঙ্গে সড়কে নেমেছে। এ জন্য স্কুল ও অফিসের সময়ে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন কাজগুলো সম্পন্ন হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। রাজধানীর সড়কে পরিচালিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ১ কোটি ৯০ লাখ কর্মঘণ্টা। যানজটে নষ্ট হওয়া অতিরিক্ত সময়ের মূল্য গড়ে ঘণ্টায় ৭০ টাকা ধরে হিসাব করলে প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সড়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শহরের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। এক্ষেত্রে ঢাকায় সড়ক রয়েছে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। যদিও গাড়ি চলাচলের মতো রয়েছে মাত্র তিন-চার শতাংশ সড়ক। ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সড়কে কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল করেছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারিত্ব। এদিকে, স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের (এসটিপি) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৫ ভাগ যাত্রী ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করেন। অথচ ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে থাকছে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ৮৫ ভাগ মানুষের ব্যবহৃত গণপরিবহনে সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ ব্যবহৃত হয়।

ডিএমপির তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সাহেদ আল মাসুদ বলেন, প্রতিদিন রাস্তায় নতুন গাড়ি নামছে। গাড়ির সংখ্যা বেশি, অথচ রাস্তা কম। রাস্তায় গণপরিবহন ১০ শতাংশ হলে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা ৯০ শতাংশ। করোনার কারণে দীর্ঘদিন পর সব খুলে দেওয়ায় যানজট বাড়ছে। আমরা গাড়ির চাপ সামলাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। তীব্র গরমে ট্রাফিক পুলিশসহ যাত্রীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যানবাহনের তীব্র চাপের মধ্যেও স্বাভাবিক চলাচল ধরে রাখার চেষ্টা করছি। যানজট নিরসনে সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

সর্বশেষ খবর