শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

মহাস্থানগড়ে গুপ্ত সময়ের নিদর্শন

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

মহাস্থানগড়ে গুপ্ত সময়ের নিদর্শন

ইতিহাস-ঐতিহ্যের সন্ধানে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের ‘বৈরাগীর ভিটায়’ খননে বেরিয়ে এসেছে গুপ্ত সময়ের নিদর্শন। এ ছাড়া একটি বৌদ্ধ মন্দিরের অবকাঠামো বেরিয়ে এসেছে।

বগুড়ার মহাস্থানগড়ের বৈরাগীর ভিটায় প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা খননে যে নিদর্শন মিলেছে তার অধিকাংশই গুপ্ত আমলের ও গুপ্ত আমলের পরবর্তী সময় এসব ব্যবহার হয়েছে। সেই হিসাবে প্রায় দেড় হাজার বছর আগের নিদর্শন বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন। বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরী বগুড়ার মহাস্থানগড়। আড়াই হাজার বছর আগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ছিল এ নগরী। মহাস্থানগড়ের ভিতরের একটি অংশের নাম বৈরাগীর ভিটা। প্রাচীন দুর্গনগরী মহাস্থানগড়ের জাহাজঘাটা থেকে দক্ষিণে এবং পরশুরাম প্যালেসের উত্তরে বৈরাগীর ভিটার অবস্থান। এ স্থানটি একটি রাজবাড়ি ছিল বলে ধারণা করা হয়। সেই সময়ের রাজা কর্তৃক মুনি, ঋষি বা বৈরাগীর সেবা করা হতো বলে স্থানটির নাম বৈরাগীর ভিটা। মহাস্থানগড়ের দুর্গ নগরীর প্রাচীরের দক্ষিণে অবস্থিত বৈরাগীর ভিটায় ১৯২৮ সালের দিকে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে পাল আমলের প্রাথমিক ও শেষ যুগের দুটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ঠিক তার পাশেই লাগানো স্থানের নাম ধরা হয় লইয়েরকুড়ি বা মহাস্থানভিটা হিসেবে। প্রত্নতত্ত্ব কিছু পাওয়ার আশা থেকে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের লইয়েরকুড়ি ও বৈরাগীর ভিটায় খননকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর। খননকাজটি শেষ হয় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। খননকাজ করে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স যৌথভাবে। ওই সময় প্রায় দুই মাস খননের পর পাওয়া যায় গুপ্ত, পাল ও মৌর্য্য আমলের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অবকাঠামো ও বেশ কিছু প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নিজস্ব অর্থায়নে খননকাজ পরিচালনা করার পর উন্মোচিত অবকাঠামো নিয়ে গবেষণা করা হয়। এরপর আবারও চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে খননকাজ শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস থাকায় মাঝে খননকাজ ছিল না। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার কারণে আবারও খননকাজ শুরু হয়েছে। খননে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। বৈরাগীর ভিটায় খননকাজে নিয়োজিতরা বলছেন, এ বছর খননের প্রথমেই মিলেছে প্রাচীন আমলের সিলিং বা সিলের। একই স্তর থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি পোড়া মাটির মাথা। পোড়া মাটির মাথা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, সেটি গুপ্ত-পরবর্তী সময়ের। প্রাচীন লিপিযুক্ত এই সিলে থাকা লিপির পাঠোদ্ধার করা গেলে ধারণা পাওয়া যাবে তা কোন আমলের এবং কী কাজে ব্যবহৃত হতো। খননে পাওয়া গেছে একটি বৌদ্ধমন্দির কমপ্লেক্স। সেখানে আরও খনন করে পুরো সন্ধান চালাচ্ছেন উৎখননে নিয়োজিতরা। বর্তমানে যে স্থান খনন হচ্ছে তার থেকে কিছু দূরে আগের একবার খননে বৌদ্ধমন্দিরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এবার বেরিয়ে পড়া বৌদ্ধমন্দির কমপ্লেক্সের সঙ্গে এটির মিল রয়েছে। এবার বৌদ্ধমন্দিরটি আবিষ্কার হলে সেখানে পাশাপাশি দুটি বৌদ্ধমন্দিরের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাবে। চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে শুরু হওয়া খননকাজটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে খননে এখন পর্যন্ত দুটি বৌদ্ধ স্তূপ (সমাধিসৌধ), প্র্রাচীন লিপি খচিত সিল, পোড়া মাটির নারী অবয়বের মাথা, অলংকৃত ইট, ভগ্ন মৃৎপাত্রসহ বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান মিলেছে। পুরো খনন সম্পন্ন হলে সেখানে প্রাচীন স্থাপত্য কাঠামো ছাড়াও অনেক প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান মিলবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা জানান, বৈরাগীর ভিটায় খননের মাধ্যমে আরও প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শন উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত সময়ের খননে উন্মোচিত বৌদ্ধমন্দিরের ঠিক উত্তর পাশেই আর একটি প্রাচীরের নিদর্শন বেরিয়ে এসেছে। এই প্রাচীরটি সম্ভবত আর একটি বৌদ্ধমন্দির কমপ্লেক্স। সেই প্রাচীরের বেষ্টনীর সন্ধান করতেই এখন খনন পরিচালনা করা হচ্ছে। সেটি পূর্ণাঙ্গ উন্মোচিত হলে বলা যাবে যে, সেখানে পাশাপাশি দুটি মন্দির ছিল। ইতোমধ্যেই সেখানে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর যে সিলটি পাওয়া গেছে তার পাঠোদ্ধারের জন্য সিলের ছবি তিনি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে রিপোর্ট পেলে সিলটির সময়কাল এবং তাতে লিপিবদ্ধ বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা পাওয়া সম্ভব। এখানে খননকাজ আরও এক মাস চলবে। চলতি বছর খননকাজে ফিল্ড পরিচালক রয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের বগুড়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা। এই খননকাজে দলনেতা হিসেবে রয়েছেন মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা। খননকাজে যুক্ত রয়েছেন রংপুরের তাজহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের প্রধান নকশা অঙ্কনকারী আফজাল হোসেন মন্ডল, সহকারী কাস্টোডিয়ান হাসনাত বিন ইসলাম, আলোকচিত্রী আবুল কালাম আজাদ, সার্ভেয়ার মুর্শিদ কামাল ভূঁইয়া ও আলোকচিত্র মুদ্রাকর দিদারুল আলম। স্থানীয়ভাবে নির্ধারিত ১৬ জন শ্রমিক এই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন খননকাজে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর