শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস আজ

ভালো নেই অটিস্টিক শিশুর পরিবার

জিন্নাতুন নূর

রুপালি শিকদার (৩৩) একটি এনজিওতে কাজ করেন। তার ১০ বছর বয়সী শিশু স্বপ্নীল অটিস্টিক অর্থাৎ মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। জন্মের পর এটি বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে রুপালি বুঝতে পারেন তার ছেলে অটিজমে আক্রান্ত। এক সময় রুপালি ভালো আবৃত্তি এবং মঞ্চনাটক করতেন কিন্তু স্বপ্নীলের আচরণগত সমস্যার জন্য ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক চর্চাগুলো থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বাইরে নিয়ে গেলে অন্যরা বিরক্ত হতে পারে এ আশঙ্কায় স্কুল ও অফিস ছাড়া অন্য কোথাও খুব বেশি স্বপ্নীলকে নিয়েও যান না। কথা হলে এই মা অনেকটা উদাসী গলায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘খুব ইচ্ছা করে মঞ্চনাটক দেখতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে কিন্তু ছেলের কথা ভেবে কোথাও আর যাই না। আবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে ঘুরতে মন চাইলেও ছেলের জন্য পারি না।’

ধ্রুবনীল রহমান (১২) ঢাকার একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে পড়ে। অন্য শিশুদের সঙ্গে খুব একটা মিশে না। মা নীলা ও বাবা সজীব রহমানই ধ্রুবের বন্ধু। শিশুটি পশু-পাখি খুব পছন্দ করে। বাইরে বের হলে পথের কুকুর-বিড়ালদের আদর করতে চায়। কিন্তু কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলে খেতে চায় না। জোরে চিৎকার করে। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়েও স্বস্তি নেই। বেশিক্ষণ থাকতে চায় না, হাত-পা ছুঁড়ে জোরে কান্নাকাটি করে। নীলা বলেন, ‘কারও জন্মদিন অনুষ্ঠানে গেলে কেকটা নষ্ট করে ফেলে। এ ভয়ে জন্মদিনের পার্টিতে আমরা যাই না। আবার পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ওর চিৎকারে আত্মীয়রাও বিরক্ত হয়। তারা মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারি। এখন প্রয়োজন না হলে আত্মীয়দের বাসায়ও যাই না। রেস্টুরেন্টেও কম যাই।’ এ তো গেল অটিস্টিক শিশুদের কথা। প্রাপ্তবয়স্ক অটিস্টিক শিশুরাও একপ্রকার সমাজবঞ্চিত। গ্রিনরোডের বাসিন্দা নাবিলা ফেরদৌসী (৩০)। অটিস্টিক এ তরুণী থাকেন তার বড় ভাই সিফাতের সঙ্গে। মা ফেরদৌসী আক্তার দেড় বছর আগে মারা গেছেন। বাবা ছোটবেলায়ই মারা যান। ভাই সিফাত ছাড়া কারও সঙ্গেই কথা বলে না নাবিলা। অফিসের কাজ ও বোনকে সামলাতে গিয়ে এখনো বিয়ে করেননি সিফাত। গাড়ি করে মাঝেমধ্যে ঘুরতে নিয়ে যান নাবিলাকে। এ ছাড়া সারা দিনই ঘরে বন্দি থাকেন অটিস্টিক এ তরুণী। পরিণত বয়স হলেও অবিবাহিত থাকায় এ ভাই-বোনদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন তাদের আত্মীয়রা।

রুপালি ও নীলার মতো মায়েরা এবং স্বপ্নীল ও ধ্রুবর মতো কোমলমতি শিশুরা এভাবে সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। এড়িয়ে যাচ্ছেন সামাজিক কার্যকলাপ। যাচ্ছে না পাবলিক প্লেসেও। অথচ অন্য আট-দশটা সাধারণ শিশুর মতো তাদেরও আনন্দ করার অধিকার আছে। অটিজমে আক্রান্ত এ শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ভালো নেই তাদের পরিবারও। অন্য আট-দশটা সাধারণ পরিবার যেখানে স্বাভাবিক জীবনযাপন করে সেখানে এ শিশুদের দেখভাল করা, তাদের বড় করা এবং স্কুলে দেওয়ার কাজগুলো করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। অটিজমে আক্রান্ত একজন শিশুর মা জানান, তার বাচ্চাকে তিনি যে বিশেষ স্কুলে দিয়েছেন সেখানে খরচ অনেক বেশি। তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এ খরচ বহন করা বেশ কষ্টের। এ অবস্থায় আজ পালিত হবে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) এর অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু বলেন, গত এক দশকে এ বিশেষ শিশু এবং তাদের পরিবারের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আচরণ অনেকাংশেই পরিবর্তন হয়েছে। একটা সময় মানুষ জানাতেই চাইতেন না তার শিশু অটিজমে আক্রান্ত। সরকার বিনোদন কেন্দ্র বা পাবলিক প্লেসে এসব শিশুকে বসা এবং খেলার ব্যবস্থা করলে খুব ভালো হবে। এসব শিশুকে চিহ্নিত করার জন্য যে জনবল তা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা শুধু এ শিশুদের ঘর থেকে বের করে আনতে পেরেছি। আরও অনেক কাজ করতে হবে। যদি বাচ্চার এক থেকে দুই বছরের মধ্যে শনাক্ত করা সম্ভব হয় যে, সে অটিজমে আক্রান্ত তাহলে ম্যানেজমেন্ট দিয়ে এ শিশুদের অটিজমের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। তখন এ শিশুকে সাধারণ স্কুল থেকে শুরু করে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ জন্য সন্তানদের মধ্যে বিশেষ কিছু দেখলেই অভিভাবকদের ইপনা’র মতো বিশেষ কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যেতে হবে।

সর্বশেষ খবর