মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বিদেশে বসে চুরির পরিকল্পনা রহস্য বের করল পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশে বসে করা পরিকল্পনায় একটি চুরির রহস্য বের করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ১৯ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুরুল হাসান ওরফে শামীম নামে একজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি কাফরুলের কচুক্ষেতে রজনীগন্ধা মার্কেটের রাঙাপরী জুয়েলার্সে চুরির ঘটনাটি ঘটে। ওই সময় মালিক দাবি করেছিলেন তার দোকান থেকে ৩০২ ভরি সোনা, ৩০ লাখ টাকার হীরা ও নগদ ৫ লাখ টাকা চুরি হয়েছে।

ডিবি জানায়, একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কৌশলে চুরি করে আসছে। রাজধানীর একটি জুয়েলার্সে চুরির ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওই চক্র সম্পর্কে জানা যায়। বিভিন্ন বিপণিবিতান, ব্যাংক ও সোনার দোকানে চুরি করাই তাদের লক্ষ্য। চুরির নিশানা নির্ধারণের পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় তারা বাসা ভাড়া নেন। লক্ষ্যবস্তুর আশপাশে নেন দোকান ভাড়া। দলের এক বা একাধিক সদস্য পরিচয় গোপন করে ভবনে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি নেন। চাকরি নিতে তারা ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও নাগরিকত্ব সনদ জমা দেন। সময় নিয়ে পুরো এলাকা রেকি করেন। এরপর মিশন বাস্তবায়ন করেন। একেকটি মিশন বাস্তবায়নে তাদের মাসখানেক লাগে।

ডিবির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মানস কুমার পোদ্দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গ্রেফতারের পর শামীম ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দিতে পুরো ঘটনার রহস্য বেরিয়ে আসে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোর চক্রটির প্রধান নাসির হোসাইন। তিনি জার্মানিপ্রবাসী। জার্মানিতে বসে চুরির পরিকল্পনা করেন। চুরির প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় খরচ জোগান দেন। প্রবাসী নাসিরের পরিকল্পনা দেশে বসে বাস্তবায়নে মূল দায়িত্ব পালন করেন     তার শ্যালক শামীম। নাসির দেশে থাকা অবস্থায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরি করতেন। চুরি করতে গিয়েই নাসিরের সঙ্গে শামীমের পরিচয় হয়। পরে তিনি শামীমের বোনকে বিয়ে করেন। চুরির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থের মালিক হন নাসির। চার বছর আগে তিনি জার্মানি চলে যান। সেখানে গিয়ে চুরির পরিকল্পনার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে অর্থায়ন শুরু করেন। চুরির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নাসির জার্মানি থেকে শামীমের কাছে টাকা পাঠান। আবার চুরির মালামালসহ অর্থের দুই ভাগ নাসিরকে পাঠিয়ে দিতেন শামীম। ডিবি বলছে, নাসির ও শামীম ছাড়াও চোর চক্রটির আরও ছয় সদস্য ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কাউসার মাস্টার ওরফে বাচ্চু, রাজা মিয়া, শ্রীকান্ত ওরফে বাদল, আবুল আকাল আহাদ, খায়রুল ওরফে মনির ও মাসুদ খান। তাদের মধ্যে কাউসার দেশে পরিকল্পনা-সংশ্লিষ্ট কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চক্রের সদস্যদের নিয়োগ পেতে সহায়তা করেন। রাজা তালা ভাঙায় দক্ষ। শ্রীকান্ত সোনা যাচাইয়ে পারদর্শী। আর চুরির নতুন পরিকল্পনার পর চক্রের সদস্যরা নতুন মোবাইল ফোন নেন। তারা অন্যের নামে নিবন্ধন করা সিম ব্যবহার করেন। চুরির পর সেই মোবাইল ফোন ও সিম নষ্ট করে ফেলেন। এরপর চলে যান আত্মগোপনে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে এ চক্রের সদস্যরা নিজেদের ছবি তোলেন না। পরিবার বা স্বজনের কাছে তাদের কোনো ছবিও নেই। ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার প্রায় এক মাসের বেশি আগে কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা মার্কেটের রাঙাপরী জুয়েলার্সে চুরির পরিকল্পনা করা হয়। নাসিরের পরিকল্পনায় মিশন বাস্তবায়ন করেন শামীম। সঙ্গে ছিলেন কাউসার। শুরুতে ভুয়া পরিচয়ে চক্রের দুই সদস্যকে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী মার্কেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি নেন মাসুদ ও খায়রুল। ভুয়া পরিচয়পত্র ও নাগরিকত্ব সনদ তৈরি করে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করেন কাউসার। চাকরি হওয়ার পর মাসুদ ও খায়রুল একসঙ্গে রাতে নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করতেন। মার্কেটের নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করে তারা শামীম ও কাউসারকে সরবরাহ করেন। আর কাউসার ‘নুর ইসলাম’ নাম নিয়ে রজনীগন্ধা মার্কেটে দোকান ভাড়া নেন। দোকানে আসবাব আনার নাম করে তিনি চুরির উপকরণ তালা ভাঙার সরঞ্জাম আনেন। ঘটনার দিন রাত ১২টার দিকে মিরপুর-১৪ নম্বর গোলচত্বরে আসেন শামীম, কাউসার, রাজা, শ্রীকান্ত ও আহাদ। সেখান থেকে শামীম মার্কেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মাসুদ ও খায়রুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। মাসুদ ও খায়রুল রাত ১টার দিকে তাদের মার্কেটে যেতে বলেন। মার্কেটে যাওয়ার পর কাউসারের ভাড়া দোকানে রাজা ও শ্রীকান্তকে নেওয়া হয়। কাউসার ও শামীম মার্কেটের বাইরের চারপাশ নজরদারির দায়িত্ব নেন। রাত ২টার দিকে কাউসারের দোকান থেকে তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি নিয়ে রাঙাপরী জুয়েলার্সের সামনে যান রাজা। পরে তিনি তালা ভাঙেন। এ সময় নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্বে থাকা মাসুদ ও খায়রুল রাঙাপরী জুয়েলার্সের বাইরে পাহারায় থাকেন। তালা ভেঙে দোকানে ঢোকার এক ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে অলঙ্কারসহ নগদ অর্থ নিয়ে পালিয়ে যান চোর চক্রের সদস্যরা। চুরি শেষে চক্রের সব সদস্য কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদের ভাড়া বাসায় যান। চুরি করা সোনার একটা অংশ এক ব্যক্তির কাছে ৩৬ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। সোনা বিক্রির ৩৬ লাখ টাকা, চুরি করা নগদ ৫ লাখ টাকা, বিক্রি না হওয়া সোনা ও অন্যান্য অলঙ্কার মোট নয় ভাগে ভাগ করা হয়। দুই ভাগ দেওয়া হয় নাসিরকে। তার ভাগ শামীম নিজের কাছে রাখেন। মালামাল বুঝে পাওয়ার পর যে যার মতো নিজেদের গ্রামের বাড়ি চলে যান। সূত্র বলছেন, ২০২০ সালের আগস্টে রাজধানীর ডেমরার হাজি হোসেন প্লাজায় নিউ কেয়া জুয়েলার্সের ২০০ ভরি সোনা ও দেড় লাখ টাকা চুরির ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এ চুরির ঘটনার রহস্য উদ্?ঘাটন করা যাচ্ছিল না। রাঙাপরী জুয়েলার্সের চুরির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্ঘাটন করে দুটি ঘটনার সঙ্গে একই চোর চক্র জড়িত।

 

সর্বশেষ খবর