বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

সংকট-সমস্যায় ত্যক্ত নগরবাসী

রাস্তায় বের হলে যানজট, ঘরে মশার উৎপাত, গ্যাস পানি বিদ্যুৎ নিয়ে ক্ষোভ, বাড়তি যোগ হয়েছে সেবা খাতের ভুতুড়ে বিল

জিন্নাতুন নূর

রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের একজন বাসিন্দা ভুতুড়ে পানির বিলের অভিযোগ করতে যান মহাখালীর ওয়াসা অফিসে। সে অভিযোগ নেয়নি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট বাসিন্দা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে পানির বিল আসত প্রতি মাসে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা। হঠাৎ করে গত দুই মাসে প্রথম ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আসে। আর এ মাসে এসেছে ৫০ হাজার টাকা। অভিযোগ করতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কক্ষে প্রবেশও করতে পারেননি তারা। এভাবে অন্যান্য সেবা খাতেও নগরবাসী ভুতুড়ে বিলের কবলে পড়ছেন। আর অভিযোগ করতে রাস্তায় বের হয়েই পড়ছেন যানজটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কবলে থাকলেও অসহায়ত্ব প্রকাশ করা ছাড়া কিছুই করার নেই। উত্তরার অধিবাসী মঞ্জুরুল আহসান বলেন, তিন দিন আগে রাত ১১টায় র‌্যাডিসন হোটেলের বিপরীতে যানজটের কবলে পড়েন। রাত সোয়া ১টায় পৌঁছেন রাজলক্ষ্মীর সামনে। যানজটের এখন রাত আর দিন বলে কিছু নেই। উত্তরা থেকে গাজীপুর যাওয়ার অবস্থা ভয়াবহ। টঙ্গী-গাজীপুর সড়কটি ১২ বছর ধরে শুধু মেরামতই হচ্ছে। কবে শেষ হবে এই কাজ কেউ জানে না। শুধু নগর নয়, মহাসড়কেও এখন যানজট হয়। রাজধানীতে এখন ১২ মাসই যানজটসহ নাগরিক সমস্যা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাগরিক সংকট দূর করতে আরও বেশি সমন্বয় এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।

সবকিছু মিলিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতি সম্পর্কে নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোজার সময় এতগুলো নাগরিক সমস্যা যা দেখা যাচ্ছে তা ইচ্ছা করলেই সমাধান করা যায়। আমি ধারণা করছি সরকারকে বিব্রত করার জন্য সরকারের মধ্যে থাকা পাওয়ারফুল লোকগুলোই এ কাজ করছেন। ঠিক রোজার আগে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হলো কেন! এই ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। পৃথিবীতে শুধু বাংলাদেশেই রোজার সময় নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়। কিছু ব্যবসায়ী রমজান মাসকে কেন্দ্র করেই মানুষের গলায় পাড়া দিয়ে আয় করতে চান। প্রতি বছর যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় তখন এর কারণ জানতে চায় সরকার। কিন্তু এটি কেন হয় তা ছয় মাস আগেই বের করা উচিত। এই ঘটনাগুলোর রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত।’ চৈত্রের শেষে এসে ভ্যাপসা গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। রোজা শুরুর সঙ্গে এক লাফে ইফতারে ব্যবহৃত খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বাড়তি ভোগান্তি হিসেবে যুক্ত হয়েছে গ্যাস ও পানি সংকট। দুর্ভোগ বাড়িয়েছে লোডশেডিং। আবার শহরজুড়ে তীব্র যানজটও মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। যানজটে রোজাদারদের অনেকেই গণপরিবহন ও প্রাইভেট কারে বসে শুধু পানি পান করে রোজা খুলছেন। সব মিলিয়ে মানুষ এখন ত্যক্তবিরক্ত।

কর্মজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার রোজাদাররা ঘরের বাইরে বের হয়ে দীর্ঘ সময় যানজটে পড়ে একদিকে যেমন কাহিল হয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে গ্যাস সংকটে তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়ছে। গ্যাস স্বল্পতার জন্য মানুষজন খাবার ও ইফতার বানাতে ঝামেলায় পড়ছেন। আবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে গতবারের তুলনায় এবার হোটেল-রেস্টুরেন্টে বানানো ইফতারসামগ্রীর দামও বেড়েছে। আবার বাজারে ইফতারে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যমূল্য- যেমন ছোলা, চিনি, বেগুন, শসা, ধনেপাতা, পিঁয়াজ, মাংসের দামও বেড়েছে।

রোজায় অফিস থেকে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইফতার করার ইচ্ছা থাকলেও তৃতীয় রোজাতেও তা পারেননি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান। মতিঝিল থেকে বেলা ৩টায় মিরপুরে বাসার উদ্দেশে রওনা দিয়েও ইফতারের আগে পৌঁছতে পারেননি। শেষে যানজটে বাসের মধ্যে বোতলজাত পানি পান করে রোজা খোলেন সিদ্দিকুর। তীব্র যানজটের জন্য ইফতারের সময় সিদ্দিকুরের মতো অন্য রোজাদারদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন সড়কে চলা মেগা প্রকল্পের কাজের জন্য সড়ক খুঁড়ে রাখায় যানজট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর সঙ্গে সড়কে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

রোজার প্রথম দিন থেকে হঠাৎ করে গ্যাস সংকট শুরু হওয়ায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস স্বল্পতা সৃষ্টি হচ্ছে। দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো বলছে, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ শেষ হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই গ্যাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এরই মধ্যে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের সংকট কাটতে শুরু করেছে বলে গতকাল নিশ্চিত করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। যোগাযোগ করা হলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিডেটের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। আগের চেয়ে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়েছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও ২ থেকে ৩ দিন লাগবে।’ গ্যাস সংকটে এরই মধ্যে ভোগান্তি বেড়েছে গ্রাহকের। মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার বাসিন্দা বিলকিস বানু গতকাল সকালে তার বাসার ছাদে মাটির চুলায় রান্না বসিয়েছিলেন। তিনি জানান, কোনোমতে রাতের খাবার ও সাহরি বানালেও রোজার প্রথম দিন থেকেই গ্যাস স্বল্পতার কারণে ইফতার বানাতে পারছেন না। তার পরিবারকে হোটেল থেকে ইফতার কিনে খেতে হচ্ছে।

গ্যাস সংকটের কারণে নগরীর সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস নেওয়ার জন্য সকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। গ্যাস নিতে না পেরে অনেক সিএনজি অটোরিকশাচালক এক বেলা চালিয়ে অন্য বেলা গাড়ি চালানো বন্ধ রাখেন।

গ্যাসের অভাবে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এবার রোজায় বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে সরকার ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে এবং গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য দেশের সব সিএনজি স্টেশন আরও এক ঘণ্টা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু এর পরও রোজার প্রথম দিন থেকেই গ্যাস সংকটের জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসীকে। এদিকে গরম শুরু হওয়ায় বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। সেচকাজের জন্যও বিদ্যুতের চাহিদা এখন বেশি। এ অবস্থায় ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় রাতে-দিনে প্রায়ই লোডশেডিং হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলাশহরে এরই মধ্যে লোডশেডিংয়ের জন্য গ্রাহকরা অভিযোগ করতে শুরু করেছেন। নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে অপারগ। যে সংকটগুলো আমরা মানসিক ও পারিপার্শ্বিকভাবে মোকাবিলা করতে পারি, সেগুলোর ক্ষেত্রেই আমরা অবহেলা ও অবজ্ঞা প্রকাশের মাধ্যমে একে জটিল করে তুলছি। শুধু গণপরিবহনভিত্তিক একটি চলাচল ব্যবস্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে আমরা সাংঘাতিকভাবে বিমুখ। ব্যক্তিগত গাড়ি ও পাতালরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মানুষের চলাচল বন্ধ হতে চলেছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছায় স্বল্প খরচে সবচেয়ে বেশি মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়ার যে গণপরিবহনভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবনা সেগুলো সবার কাছে পরিষ্কার। সেগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে করা হচ্ছে না। এ মুহূর্তে দেশে এমন কোনো সংকট নেই যাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। কৃষক দাম পাচ্ছে না, অথচ সেই একই পণ্য গুদামে যাওয়ায় দাম তিন গুণ বেশি হয়ে যায়। বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এই পুরো বিষয়টি নজরদারি করা উচিত। রোজার মাস সামনে রেখে একদল মাফিয়া, মজুতদার পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে। আর যানজট নিরসনে যদি আমরা কিছু কারণ বের করতাম তাহলে এর নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হতো।

নগরজুড়ে মশার উৎপাতেও মানুষ এখন অতিষ্ঠ। দিনে-রাতে মশার কামড়ে ঢাকাবাসী ত্যক্ত-বিরক্ত। সন্ধ্যার পর কয়েল জ্বালিয়েও মশার উৎপাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। গরমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরই মধ্যে ওয়াসার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। মিরপুর, উত্তরার অনেক বাসিন্দা কয়েক দিন ধরে খাওয়ার পানির অভাবে ভুগছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এ দুটি এলাকা ছাড়াও সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে যেসব এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয় সেসব এলাকায় পানি সংকটের পাশাপাশি পানিতে দুর্গন্ধও বেড়ে গেছে। যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মানিকনগর, বাসাবো এলাকার বাসিন্দারা কয়েক দিন ধরেই পানি সংকটে ভুগছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর