বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

আট বছর পর ফারুকী হত্যার রহস্য

মাহবুব মমতাজী

আট বছর পর ফারুকী হত্যার রহস্য

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে আট বছর পর মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যা রহস্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। চাঞ্চল্যকর ওই হত্যার প্রায় চার বছর পর এবং আট বছর পর জড়িত দুই আসামি আদালতে ইতোমধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের তথ্যেই বেরিয়ে এসেছে যে, হত্যা পরিকল্পনায় ছিল জেএমবি আর বাস্তবায়ন করেছে আনসার আল ইসলাম। হত্যায় জড়িত দুজন জঙ্গিবাদের অন্য মামলায় গ্রেফতারের পর জামিনে বেরিয়ে পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে সিআইডি। আদালত ও সিআইডি সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

এদিকে ৫ মার্চ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ভুয়া পাঁচ ডিবির মধ্যে সোহাগ ও বাপ্পী নামে দুজন ছিলেন ফারুকী হত্যায় জড়িত জঙ্গি সদস্য। 

তবে সিআইডির কোনো কর্মকর্তা এসব নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। গত এক সপ্তাহ চেষ্টা চালিয়েও কারও কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বের করে আনা সম্ভব হয়নি।

ঘটনার চার বছরের মাথায় ২০১৮ সালের ৩০ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে প্রথম জবানবন্দি দেন হাদিসুর রহমান সাগর। দুর্ধর্ষ এই জঙ্গির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মধ্য দিয়ে মূলত জট খুলতে শুরু করে টেলিভিশন উপস্থাপক ও ইসলামী ফ্রন্টের নেতা মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যা রহস্যের। কেন, কারা, কী কারণে তাকে হত্যা করেছে তা জানা যায়।

তবে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, মামলাটির তদন্ত চলমান আছে। আদালত সূত্র জানায়, হাদিসুর রহমান সাগরের দেওয়া জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে ফারুকী হত্যা মিশনে জেএমবির দুটি অংশ সম্মিলিতভাবে অংশ নিয়েছিল। হত্যা মিশনে নয়জন সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। আর কিলিং মিশনের মূল কমান্ডার ছিলেন আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে জামাই ফারুক। হত্যার আগে আশুলিয়ায় বৈঠক করে চূড়ান্ত হয় ফারুকী হত্যার ছক। এই জবানবন্দির প্রায় চার বছর পর ২৭ মার্চ আদালতে আরেক জঙ্গি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি হলেন আবদুল্লাহ আল তাসনীম। এর পরই ফারুকী হত্যা মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের মতে, দ্রুতই ফারুকী হত্যার পুরো রহস্য উদঘাটন করে সবাইকে জানানো সম্ভব হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাগর যখন জবানবন্দি দেন তখন মামলাটির তদন্ত তদারকিতে ছিলেন সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম। আর তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার। তাসনীম যখন জবানবন্দি দিলেন তখন তদন্ত তদারকির দায়িত্বে আছেন অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন। তদন্ত কর্মকর্তা হলেন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিসানুল হক। এর মাঝখানে আরও অন্তত ৫/৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। তাসনীমের জবানবন্দি আদালতে রেকর্ডের আগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল সিআইডি। এরপর দ্বিতীয় দফায় আরও ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। এই রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনই জবানবন্দি দেন তাসনীম। আদালত ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগেই সাগর স্বীকার করেছিলেন ফারুকী হত্যায় জেএমবির ভিতরের ও বাইরের দুটি গ্রুপ অংশ নেয়। সাধারণত মাওলানা সাঈদুর রহমানের গ্রুপকে জেএমবির ভিতরের গ্রুপ বলে অভিহিত করা হতো। আর আবদুর রহমান ওরফে সারওয়ার জাহান মানিক ও ডা. নজরুল ইসলামের গ্রুপ বাইরের গ্রুপ বলে পরিচিত। ফারুকী হত্যাকান্ডের আগের দিন ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় আশুলিয়ায় একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পাশে জেএমবির ভিতরের ও বাইরের দুই গ্রুপ একত্র হয়। সেখানে উপস্থিত ছিল মানিক, জামাই ফারুক, সাগর, আবদুল্লাহ আল তাসনীম ওরফে নাহিদ, আশফাকসহ অন্তত নয়জন। মূলত দুই গ্রুপ সমঝোতার জন্য একত্র হয়েছিল সেখানে। মানিক ও নজরুল গ্রুপের সদস্য হিসেবে সাগর ঘটনার দিন আবদুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়ার বৈঠকে যান। তবে সমঝোতা আলোচনার বাইরে ওই বৈঠকে ফারুকীকে হত্যার ব্যাপারে আলোচনা হয়। জঙ্গিদের মধ্যে কয়েকজন সেখানে তাদের ভাষায় ব্যাখ্যা দেয়- ‘ফারুকী কোরআন-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। একইভাবে আল্লাহ ও নবীকে নিয়ে অপব্যাখ্যা দেন তিনি।’ তারপর ফারুকীকে হত্যার ছক চূড়ান্ত করেন তারা। পরদিন তার ফার্মগেটের বাসায় চলে যেতে বলা হয় সবাইকে। সাগর ছাড়াও তাসনীমের দেওয়া জবানবন্দিতেও এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর বাসায় মাওলানা ফারুকীকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় করা মামলাটি পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়। ডিবির তদন্তে কোনো ফল না আসায় মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফারুকীর হত্যা মিশনের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের আমির ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাসনীম। তবে মূল অপারেশনের কমান্ডার করা হয় জেএমবির দুর্ধর্ষ সদস্য জামাই ফারুককে। ২০১৭ সালে তিনি ভারতে গ্রেফতার হন। ফারুকী হত্যা ছাড়াও ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হত্যা করে ত্রিশালে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন ফারুক। দীর্ঘদিন ভারতে পলাতক ছিলেন তিনি। তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ভারত। ২০১৪ সালের শেষের দিকে পুলিশ তাসনীমকে গ্রেফতার করে। আর মানিক সাভারে র‌্যাবের একটি অভিযানে নিহত হন। এ ছাড়া হত্যায় জড়িত আশফাক নামে আরেকজন কারাগারে রয়েছেন। দুজন আছেন পলাতক। অনুসন্ধানে জানা যায়, আবদুল্লাহ আল তাসনীমের জবানবন্দিতে ফারুকী হত্যায় জাহিদুল ইসলাম সোহাগ ও বাপ্পী মিয়ার নাম পাওয়া যায়। এর আগেই তারা ডিবির রমনা বিভাগের এক অভিযানে ভুয়া ডিবি হিসেবে গ্রেফতার হয়েছেন। ৫ মার্চ যাত্রাবাড়ীর কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পশ্চিম পাশে ডিবি পুলিশ পরিচয় দেওয়া পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিবির রমনা বিভাগ। এদের মধ্যে জাহিদুল ইসলাম সোহাগ নিজেকে ডিবির এসি সোহাগ বলে পরিচয় দেন। বাপ্পী মিয়া নিজেকে ডিবির এসআই বলে পরিচয় দেন। এরা দুজনই মাওলানা ফারুকী হত্যায় জড়িত বলে তাসনীমের জবানবন্দিতে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কাজলার অভিযানে আরও গ্রেফতার হয়েছিলেন রুহুল আমিন, রাজু আহম্মেদ ও মাসুদ মিয়া। পলাতক রয়েছেন শোয়েব হাওলাদার ও মো. আশরাফ। গ্রেফতারের সময় একজনের হাতে ওয়াকিটকি, দুজনের গায়ে খাকি রঙের ডিবি জ্যাকেট ছিল। আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে তাসনীম বলেছেন- ফারুকীর বাসায় যখন তারা যান তখন ওই বাসায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে তার সাতজন ভক্ত ছিলেন। বাসায় প্রবেশ করামাত্রই তারা ওই সাতজনের হাত-পা, মুখ ও চোখ বেঁধে ফেলেন। এর পরই ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর