বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

যানজটে অভিশপ্ত রাজধানী

সাড়ে ৬ কিলোমিটার যেতে পৌনে চার ঘণ্টা । নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা । ঘটছে শব্দ ও বায়ুদূষণ । বাড়ছে যাতায়াত খরচ । এক ডজন কারণে যানজট

শামীম আহমেদ ও হাসান ইমন

যানজটে অভিশপ্ত রাজধানী

দক্ষিণ বনশ্রীর ৭ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সায়েমা আফরিন বর্ণালী। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে অংশ নিতে গত মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) সকাল সোয়া ৮টায় ওঠেন উবারের সিএনজি অটোরিকশায়। ৯টায় সেমিনার শুরু হলেও বর্ণালী পৌঁছান সাড়ে ১০টায়। এর মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সেমিনারের প্রথম সেশন। তার বান্ধবী শারমিন একই সেমিনারে অংশ নিতে সকাল সাড়ে ৭টায় মালিবাগ থেকে ওঠেন বাসে। পৌঁছান ১১টা ১০ মিনিটে। সিএনজি অটোরিকশায় ৮ কিলোমিটার যেতে বর্ণালীর লেগেছে সোয়া ২ ঘণ্টা, আর বাসে সাড়ে ৬ কিলোমিটার যেতে শারমিনের লেগেছে ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। রাজধানীর যানজটের ভয়াবহতা  ক্রমেই বাড়ছে। রমজানে এই চিত্র আরও খারাপ হয়েছে। একের পর এক ফ্লাইওভার, ইউলুপ নির্মাণেও কমছে না  ভোগান্তি। রাস্তাতেই নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। সড়কে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে পুড়ছে জ্বালানি। বাড়ছে বায়ু ও শব্দদূষণ। শেষ করা যাচ্ছে না দিনের কাজ। ‘দ্য ফিউচার প্ল্যানিং অব আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টার অপচয় ঘটছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬ : ঢাকা মহানগরে যানজট-শাসন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার, ২০১৬ সালে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে দাঁড়ায়। গত মঙ্গলবার শিক্ষার্থী শারমিন বাসে চড়ে প্রতি ঘণ্টায় পাড়ি দিয়েছেন মাত্র ১ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার, যা হাঁটার গতির চেয়ে কম। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় গুগলে লোকেশন নির্ধারণ করলে মতিঝিল থেকে পল্টন বাস স্টপ পর্যন্ত ১ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ১৩ মিনিট ও বাসে ২৯ মিনিট লাগবে বলে সম্ভাব্য সময় দেখানো হয়। যানজটে শুধু সময়ই নষ্ট হচ্ছে না, বাড়ছে যাতায়াত খরচও। শিক্ষার্থী বর্ণালী বলেন, উবারের সিএনজি অটোরিকশায় ওঠার সময় অ্যাপে ভাড়া দেখিয়েছিল ১৮৩ টাকা। পৌঁছানোর পর দিতে হয়েছে ৩২৪ টাকা। যানজটের কারণে ১৪১ টাকা বেশি লেগেছে। স্কুল, ভার্সিটি, অফিসের সবাইকে এক সময়েই গন্তব্যে যেতে হবে কেন? পরিকল্পনাবিদরা কি পারতেন না একেকটা পেশার মানুষদের আলাদা সময়ে রাস্তায় নামাতে?

সরেজমিন রাজধানী ঘুরে ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় যানজটের  পেছনে অন্তত এক ডজন কারণ পাওয়া গেছে।

শেষই হয় না মেগা প্রকল্প : ২০১৪ সালে বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় খেলোয়াড়দের যাতায়াতের জন্য মিরপুরের পূরবী থেকে কালশী পর্যন্ত ভাঙাচোরা সড়কটি এক রাতেই কার্পেটিং করে ফেলা হয়। অথচ বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি ১০ বছরেও শেষ হয়নি। এ প্রকল্প এখন ঢাকা ও গাজীপুরের যানজটের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তা আটকে উন্নয়ন কাজ ও ভাঙাচোরা সড়কের কারণে ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগছে ৩-৪ ঘণ্টা। প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১২ সালে। শেষ হওয়ার কথা ২০১৬ সালে। অথচ এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ। চার দফা বেড়েছে সময়। ব্যয় ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকায়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ, ভূগর্ভস্থ ও ওভারহেড ইউটিলিটি স্থানান্তর ও বিদ্যমান সড়কের অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়েছে। এ ছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অপর্যাপ্ত অর্থপ্রবাহ ও জনবল সংকট ছিল। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।

সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি : রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একই রাস্তা একাধিকবার খোঁড়া হচ্ছে। মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ লাইন, পানির লাইন, পয়ঃনিষ্কাশন লাইন অথবা মাটির নিচ দিয়ে ক্যাবল নেটওয়ার্ক নিতে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল।

অবৈধ পার্কিং : পার্কিং ব্যবস্থা নেই ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ মার্কেটে। বেসরকারি মার্কেট ও শপিং মলগুলোর কিছু অংশে পার্কিং ব্যবস্থা থাকলেও তা অপর্যাপ্ত। এসব মার্কেটে আসা মানুষেরা সড়কেই পার্কিং করছে গাড়ি। এতে চলাচলে দুর্ভোগের সঙ্গে বাড়ছে যানজটও।

হস্তচালিত সিগন্যালিং ব্যবস্থা : দেশ যখন ডিজিটালাইজেশনের হালনাগাদ সংস্করণ ‘ফাইভ-জি’ যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তখনো ঢাকা শহরে হাতের ইশারায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে ট্রাফিক পুলিশ। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় কোনো সড়ক টানা ১০ মিনিটের বেশিও বন্ধ থাকছে। এতে সৃষ্টি হওয়া গাড়ির জট ছাড়িয়ে যাচ্ছে কয়েক কিলোমিটার। অথচ ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য গত ২২ বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। ব্যয় হয়েছে ১১৯ কোটি টাকা।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় গলদ : রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা ভিআইপি মুভমেন্টের কারণে রাজধানীতে হঠাৎ হঠাৎ রোড ডাইভারশন করা হচ্ছে। পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ রাস্তা বন্ধ হওয়ায় অনেকেই ভুল করে ওই সড়কে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ছেন। ঘুরতি পথে ফিরতে গিয়ে নিজেরাও যানজটে পড়ছেন, আবার যানজট সৃষ্টিতে রসদ জোগাচ্ছেন।

একই সড়কে বিভিন্ন গতির যানবাহন : রাজধানীর মূল সড়কে দ্রুত গতির বাস-প্রাইভেট কারের পাশাপাশি চলছে রিকশা। ফলে সব গাড়িকেই রিকশার গতিতে চলতে হচ্ছে। একাধিকবার রাজধানীর মূল সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পর্যাপ্ত গণপরিবহন নিশ্চিত করতে না পারায় সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।

বাসের স্বেচ্ছাচারিতা : রাজধানীতে সবগুলো লেন দখল করে চলে বাস। যাত্রী তুলতে হরহামেশা যে কোনো স্থানে দাঁড়িয়ে পড়ছে। পেছনের বাস আটকে দিতে বাঁকা করে বাস দাঁড় করিয়ে পুরো রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে আটকা পড়ছে সব যানবাহন। যদিও ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আনিসুল হক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর কার্যক্রম থমকে যায়। সর্বশেষ গত বছর ২৬ ডিসেম্বর ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত একটি রুটে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস চালানো শুরু করে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। কিন্তু ওই রুটে অন্য পরিবহন চালু থাকায় শৃঙ্খলা ফেরেনি।

যানবাহনের তুলনায় সংকীর্ণ সড়ক : বাসিন্দাদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য একটি আদর্শ শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন হলেও রাজধানীতে রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। তার একটি অংশ আবার মোটরযান চলাচলের অনুপযোগী। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট।

গণপরিবহন সংকটে ছোট যানবাহন বৃদ্ধি : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে ৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৫টি, যা মোট গাড়ির ৪৯ শতাংশ। প্রাইভেট কার নিবন্ধিত হয়েছে ৩ লাখ ৮ হাজার ৮৬০টি, যা মোট গাড়ির ১৮ শতাংশ। আর বাসের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৯৭৮টি, যা মোট গাড়ির ২ শতাংশ। মানসম্মত গণপরিবহন সংকটে রাজধানীতে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ি। দখল হচ্ছে সড়ক। বাড়ছে যানজট।

চৌরাস্তায় যানজট : রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের সংযোগ মুখে, বিশেষ করে তিন বা চার রাস্তার মুখে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। ইউলুপ জাতীয় কোনো ব্যবস্থা না থাকায় উত্তর-দক্ষিণমুখী যানবাহন ছাড়লে আটকে থাকছে পূর্ব-পশ্চিমমুখী যান। ২ মিনিট আটকে থাকলে গাড়ির সারি ছাড়িয়ে যাচ্ছে কয়েক কিলোমিটার। সেই যানজট ছাড়ানোর আগেই আবার সিগন্যাল দিয়ে আটকে দিতে হচ্ছে যান চলাচল।

দিনে-রাতে চলে ট্রাক : যানজট নিরসনে ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক নির্দেশনায় বলা আছে, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জরুরি রপ্তানি পণ্যবাহী ছাড়া সব ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ভ্যান, লরি রাজধানীতে চলাচল করবে না। অথচ এখন দিনেও শহরের প্রবেশপথ দিয়ে দেদার ঢুকছে ভারী যানবাহন।

প্রাণকেন্দ্রে ট্রাকস্ট্যান্ড ও আন্তজেলা বাস টার্মিনাল : শহরের মধ্যেই ট্রাকস্ট্যান্ড ও আন্তজেলা বাস টার্মিনালের কারণে বাড়ছে যানজট। দিন-রাতে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে আসা-যাওয়া করছে হাজারো ট্রাক। বিভিন্ন জেলা থেকে বাস আসা-যাওয়া করছে মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে। ফলে শহরের ভিতরে বাড়ছে গাড়ির চাপ। ট্রাকস্ট্যান্ড ও আন্তজেলা বাস টার্মিনাল মূল শহরের বাইরের দিকে নিতে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। ট্রাক টার্মিনাল নেই, শহরের ভিতরে আন্তজেলা বাস টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়েছে। এসব চিত্র পৃথিবীর কোথাও নেই। নগরীর ভিতরে তো পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত স্থান নেই। অবৈধ পার্কিং ঠেকাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, নগরটিকে গণপরিবহন ভিত্তিক ও পথচারীবান্ধব করলে সড়কের সক্ষমতা ৮-১০ গুণ বাড়ানো যেত। ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানাচ্ছি। প্রতি কিলোমিটারে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে আন্ডারগ্রাউন্ডে সাবওয়ে বানাচ্ছি। কিন্তু এই সড়ককে গণপরিবহন ও ফুটপাথনির্ভর করতে হাজার কোটি টাকাও লাগবে না। তাতে অধিকাংশ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে আধুনিক বাসে চলতে পারত। যানজট অনেকটাই কমে যেত। উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আনিসুল হক এটা শুরু করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর আর এটা এগোয়নি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর