সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

লিবিয়ায় বন্দি ২৮ তরুণকে ফেরত চায় পরিবার

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর

অবৈধ পথে ইউরোপে নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় দালালদের হাতে বন্দি মাদারীপুরের ডাসার ও কালকিনি উপজেলার ২৮ তরুণ। দালালেরা মুক্তিপণের জন্য তাদের জিম্মি করে দফাদফায় নির্যাতন চালাচ্ছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন। এ মুহূর্তে লিবিয়ায় বন্দি স্বজনদের ফেরত চায় পরিবার।

ওই দালাল চক্রের সঙ্গে কালকিনি উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরহাদ মাতুব্বর জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, তিনি টাকা নেওয়ার সঙ্গে জড়িত নন। ভুক্তভোগীরা দালালদের টাকা দেওয়ার সময় তিনি শুধু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। টাকা লেনদেনের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা গেছে, চেয়ারম্যান গুনে গুনে নিচ্ছেন টাকা।

জানা  গেছে, প্রায় চার মাস আগে ২৮ তরুণকে অবৈধ পথে ইতালিতে নেওয়ার প্রলোভন দেখান ফরহাদ মাতুব্বর। এ জন্য প্রত্যেকের সঙ্গে ৯ লাখ টাকার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রথমে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করে তারা। লিবিয়া হয়ে ইতালিতে পৌঁছানোর পর নেওয়া হবে বাকি সাড়ে ৪ লাখ। চুক্তি অনুসারে টাকা নিয়ে ২৮ তরুণকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। লিবিয়িা পৌঁছানোর পর তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে চুক্তির বাকি সাড়ে ৪ লাখ টাকা আদায় করে দালাল। টাকা দেওয়ার পর তাদের লিবিয়ার দালালদের হাতে তুলে দেয়। বর্তমানে লিবিয়ার দালালদের কাছে বন্দি ওই ২৮ তরুণের কাছে আরও ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। তরুণদের অনেকে দালালদের টাকা দিয়েও মুক্তি পাচ্ছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিবিয়ায় বন্দি ২৮ জনের মধ্যে সাতজন অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যানের নিজ এলাকার বাসিন্দা। তারা হলেন সালাম ব্যাপারীর ছেলে মেহেদী ব্যাপারী (২০), মোক্তার ব্যাপারীর ছেলে সাগর ব্যাপারী (১৯), করিম সরদারের ছেলে বনি সরদার (২২), আলী ঘরামির ছেলে ফয়সাল ঘরামি (১৯), আমির ঘরামির ছেলে এনামুল ঘরামি (১৮), আদালি ঘরামির ছেলে সোহেল ঘরামি (২৩) ও সৈকত ঘরামি (২০)। এ ছাড়া উপজেলার জনারদন্দি এলাকার আদেল উদ্দিন সরদারের ছেলে আহাদ সরদার, কবির সরদারের ছেলে হাসান সরদারসহ আরও ১৯ জন তরুণ দালালদের কাছে বন্দি আছেন। গোপালপুর এলাকার ভ্যানচালক মোক্তার ব্যাপারীর একমাত্র ছেলে সাগর ব্যাপারী তার মা রেহানা বেগমের সঙ্গে সর্বশেষ ২০ দিন আগে কথা বলেন। মায়ের সঙ্গে ছেলের শেষ কথা ছিল, ‘মা, তোমরা আমারে উদ্ধার কর, ওরা আমারে মাইরা ফালাইবে। যা টাকা চায়, ওদের দিয়া দাও।’  সাগরের বাবা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘সাগরের মুখে শেষ কথা শোনার পর থেকে আমাগো মাথায় আকাশ ভাইঙা পড়ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। চেয়ারম্যানের কাছে আমরা কয়েকজন মিইলা গেছি। চেয়ারম্যান আমাগো লগে দেখা করেন না। কথাও বলেন না। পুলিশ বা কাউকে জানালে ছেলেকে আর পাব না বলে ভয় দেখান।’  একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, এ ব্যাপারে ডাসার থানায় গেলে মামলা নেয়নি ওসি হাসানুজ্জামান। তবে পুলিশ সুপার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আরেক বন্দির বাবা আলী ঘরামি বলেন, তার ছেলে ফয়সালের সঙ্গে এক মাস ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। ছেলের কোনো খবর পাচ্ছেন না তারা। চেয়ারম্যান শুধু বলেন, তারা সবাই ভালো আছে। ছেলের সঙ্গে তাদের কথা বলিয়ে দিচ্ছেন না। জানতে চাইলে কালকিনি পৌরসভার মেয়র এস এম হানিফ বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান ফরহাদের মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি শুনেছি। তার মাধ্যমে ২৮ তরুণ লিবিয়ায় গেছেন। এর মধ্যে কয়েকজন আমার পৌরসভার বাসিন্দা।’ অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান ফরহাদ মাতুব্বর মুঠোফোনে বলেন, ‘রাসেল, সরোয়ার, ফারুক নামের কয়েকজন দালাল ওই ছেলেদের লিবিয়ায় নিয়ে গেছেন। আমি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নই। এলাকার লোকজন আমাকে জানানোর কারণে টাকা দেওয়ার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এখন যারা আমার বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ করছেন, তাদের সঙ্গে আমি কোনো কিছুতেই জড়িত নই। তারা মিথ্যা বলছেন।’ ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে ভিডিও তার নয় বলে দাবি করেন তিনি। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিপংকর তঞ্চ্যাঙ্গা বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে তিনি কোনো অভিযোগ পাননি। তারা সহযোগিতা চাইলে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইশতিয়াক আশফাক বলেন, ভুক্তভোগী ২৮ জনের অনেকেই পুলিশের সঙ্গে মানব পাচারের বিষয়টি আলাপ করেছেন। তারা মামলা করতে চান, আবার চান না। মামলা করতে তারা কিছুটা ভয়ও পান। তারা মনে করেন, মামলা হলে তাদের ছেলেকে লিবিয়ার দালালেরা মেরে ফেলবেন। দালালেরাও ভয় দেখান। এটিও সত্য। তবে বিষয়টি পুলিশের নজরদারিতে আছে। ভুক্তভোগীরা আইনি সহায়তা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। মাদারীপুর পুলিশ সুপার গোলাম মস্তফা রাসেল জানান, ‘মানব পাচারের ঘটনায় পুলিশ সতর্ক রয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মামলা করতে আসেন না। মামলা হলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

সর্বশেষ খবর