বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ঢেউ শেষ হলেই লাশ

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ঢেউ শেষ হলেই লাশ

দেখতে দেখতে ১১টি রোজা চলে গেছে। জীবনসমুদ্র থেকে ১১টি মূল্যবান ঢেউ হারিয়ে গেছে। ‘সমুদ্র’ বলায় মনে পড়ে গেল জীবনের প্রথম সমুদ্র দেখার কথা। রাত ৩টা। চারদিক সুনসান। দিনের কোলাহলে মানুষ সমুদ্র দেখে, রাতের নির্জনতায় সমুদ্র মানুষ দেখে। মন্থর গতিতে তীরভূমিতে হাঁটছি। অনেক দূরে কয়েকজন তরুণ গান করছে। সমুদ্র তাদেরও পরখ করছে। তীব্র গর্জনে ঢেউ আসছে, কূলে আছড়ে পড়েই আবার ফিরে যাচ্ছে। হঠাৎ হৃদয়ের কান খুলে গেল। কে যেন বলল, হে মানুষ! তোমার জীবনও ঢেউয়ের ছন্দে গড়া। ভালো করে খেয়াল কর, তোমার নিঃশ্বাসের আসা যাওয়া ঢেউ ছাড়া কিছুই নয়। মনের সেই অজানা কথককে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে সমুদ্র কোথায়? উত্তর এলো, সমুদ্র হলো মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা। সে সমুদ্র থেকেই তোমার মাটির দেহে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়েছে। যত দিন জীবনে ঢেউয়ের আসা-যাওয়া অর্থাৎ নিঃশ্বাস জারি থাকবে, তত দিন তুমি মানুষ, ঢেউ শেষ হলেই লাশ। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি মানুষ সৃষ্টি করে তার ভিতর আমার থেকে রুহ ফুঁকে দিলাম।’ (সুরা হিজর, আয়াত ২৯) কে তুমি পাঠক আজ আমায় পড়ছ! বিশ্বাস করছি, তুমি রোজাদার! তবে যারা রোজার মতো মূল্যবান নিয়ামত পেয়েও সুযোগ হেলায় নষ্ট করছে, তাদেরও গত ১১টি দিন কেটেছে। আর যারা রমজানের আগে থেকেই ব্যাকুল-বেকারার হয়ে রোজার জন্য অপেক্ষা করেছে, ১১টি দিন সিয়াম কিয়াম তারাবি তাহাজ্জুদ সাহরি ইফতার দান-সদকায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে, তাদের দিনও অতিবাহিত হয়েছে। তবে এ দুই দলের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য রয়েছে। কূলে আছড়ে পড়ার আগে-পরে ঢেউয়ের দৃশ্য কি একই থাকে? কখনো নয়। আছড়ে পড়ার আগে ঢেউয়ের গর্জনে বুকে কাঁপন ধরে। আর আছড়ে পড়ার পর ঢেউয়ের নীরব প্রস্থান হৃদয়ে হাহাকার জাগায়। যে ঢেউ বুকে কাঁপন ধরিয়েছে, সে ঢেউই খাঁখাঁ জাগিয়ে বুকের পাঁজর ভেঙেছে। ঢেউ কিন্তু একই। তেমনি যে রমজান রহমত বরকত জান্নাতের দুয়ার খুলে দিয়েছে, মাস শেষে যারা রমজানের ঢেউয়ে সাঁতার কাটতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের জন্য চরম যন্ত্রণাদায়ক আজাবের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

একটি বিখ্যাত হাদিস থেকে জানা যায়, একদিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে রসুল (সা.) প্রসঙ্গ ছাড়াই ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলছিলেন। সাহাবিরা জানতে চাইলেন এমনটি বলার রহস্য কী? রসুল (সা.) বলেন, জিবরাইল অভিশাপ দিয়েছে, আমি আমিন বলেছি। জীবরাইল একটি বদদোয়া করেছিল, রমজানের মতো এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও যে হতভাগা নিজের গুনাহগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না, তার জন্য ধ্বংস। আমি বললাম, আমিন। কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আফানাজআলুল মুসলিমিনা কাল মুজরিমিন। মালাকুম কাইফা তাহকুমুন। হে মানুষ! যে নিজের প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে আর যে চলেছে বাঁধনহারা হয়ে, তাদের দুজনের সঙ্গে একই আচরণ করা হবে এ তোমরা ভাবলে কীভাবে! বড়ই আশ্চর্য তোমাদের বিবেক-বিবেচনাবোধ!’ (সুরা কলম, আয়াত ৩৫-৩৬)

বলছিলাম, ঢেউ শেষ হলেই তুমি লাশ হয়ে যাবে। এর আগেই সতর্ক হয়ে যাও। জীবনসমুদ্র থেকে রমজান নামক অতিমূল্যবান ১১টি ঢেউ চলে গেলেও আরও ১৮টি ঢেউ এখনো বাকি। যা মিস হয়ে গেছে, তার জন্য আফসোস কোরো না। বরং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর, তোমার ঘুম ভেঙেছে। দোয়া কর, যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের ঘুম যেন আল্লাহ ভাঙিয়ে দেন। এখন ঢেউ কূলে আছড়ে পড়ছে, শাওয়ালের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ মিলিয়ে যাবে। সে বড় করুণ দৃশ্য। মুমিনরা আনন্দামাখা আফসোস করবে, মুনাফিকরা করবে আফসোসমাখা আনন্দ। মুমিনরা বলবে, হায়! যদি খোদার মেহমান কোরআনের মাসটি আরও কিছুদিন থাকত তাহলে কতই না ভালো হতো। অন্যদিকে মুনাফিকরা বলবে, বিপদ কেটে গেছে, এখন থেকে আর লুকিয়ে আড়ালে আবডালে খেতে হবে না। কত ভালো হতো যদি কখনো এমন যন্ত্রণাদায়ক মাস না আসত...!

হে আমার দরদি পাঠক! দুটি দৃশ্যই তোমার সামনে তুলে ধরেছি। এবার তুমিই সিদ্ধান্ত নাও ঢেউয়ে আছড়ে পড়া আনন্দে শামিল হবে, নাকি বেদনায় মিলিয়ে যাওয়া কষ্টের শিকার হবে। শেষ করার আগে মনে করিয়ে দিচ্ছি মাবুদের আয়াতখানি, ‘নিশ্চয়ই আমি তাকে পথনির্দেশ দিয়েছি। এখন এটা তার ওপর নির্ভর করে সে কৃতজ্ঞ হবে, না অকৃতজ্ঞ। আমি তো সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি শিকল, বেড়ি ও গনগনে আগুন।’ (সুরা দাহর, আয়াত ৩-৪)

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর