শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

বাদুড়ের অভয়ারণ্য নড়াইলের বাঁশগ্রাম

সাজ্জাদ হোসেন, নড়াইল

বাদুড়ের অভয়ারণ্য নড়াইলের বাঁশগ্রাম

চৈত্রের খরতাপে তীব্র গরমে পা দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলে ঘুমিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে ডানা ছেড়ে হাতপাখার মতো বাতাস করে, আর কিছুক্ষণ কিচিরমিচির শব্দ করে আবার স্থির হয়ে যায়। এভাবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নড়াইলের সদর উপজেলার বাঁশগ্রামের শত বছরের পুরনো কবরস্থানের নির্জন বাগানটি এখন বাদুড়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। উপজেলা সদরের প্রায় ৮ কিমি পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত এই বাদুড়ের অভয়ারণ্য গ্রাম। প্রাচীন এই কবরস্থানের বাগানটিতে উঁচু উঁচু চম্পল ও মেহগনি গাছে এখন বসবাস করছে অগণিত বাদুড়। এদের বসবাস, বিচরণ আর কিচিরমিচির শব্দে দিনরাত মুখরিত থাকে এলাকাটি।

সারা দিনই বাদুড়ের ছোটাছুটিতে এলাকাটিতে সৃষ্টি হয় সৌন্দর্যের অবর্ণনীয় এক পরিবেশ। সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকালে এদিক-সেদিক দেখা যায় খাদ্যের সন্ধানে ছুটে চলা উড়ন্ত বাদুড়ের দল। গোধূলি লগ্নে রক্তিম আকাশে শত শত বাদুড়ের ডানা মেলা দৃশ্যে এলাকাটিকে মনে হয় প্রকৃতির এক অপার সৌর্ন্দযের বেলাভূমি। মনোরম এ দৃশ্য দেখতে দূর-দূরন্ত থেকে অনেক প্রকৃতিপ্রেমী ছুটে আসেন এখানে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রচণ্ড দাবদাহে বাঁশগ্রামের মোল্লাবাড়ী মসজিদ-সংলগ্ন এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন নির্জন কবরস্থানের উঁচু উঁচু চম্পল ও মেহগনি গাছের শাখায় হুকের মতো পা দুটো আটকিয়ে নিস্তব্ধতায় ঝুলছে বাদুড়গুলো। ওজন প্রায় এক থেকে দেড় কেজি। মাথায় হলুদ রঙ থাকলেও পুরো দেহ কালো। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে দল বেঁধে পালক ছাড়া চামড়ায় মোড়ানো ডানা দিয়ে ঘুড়ির মতো কিচির-মিচির শব্দে নীরব স্থানে ঝুলে পড়ছে। রাতের অক্লান্ত শ্রমে যেন একটু প্রশান্তির ঘুম খুঁজছে নিশাচর এই প্রাণী।

এ সময় কবরস্থানের সবচেয়ে উঁচু চম্পল গাছের নিচে একটি কবর পরিষ্কার করতে দেখা যায় আবদুল মান্নান নামের সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধকে।

তিনি জানান, কিছুদিন আগে তার আদরের ছোট ছেলে ইন্তেকাল করেছেন। যে কারণে পুত্রশোকে কাতর এই পিতা প্রায়ই কবরস্থানে আসেন এবং বাদুড়গুলোকে পাহারা দিয়ে রাখেন। এভাবে পিতৃহারা এই পিতার বাদুড়গুলোর প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মেছে। কিন্তু প্রায়ই নছিমন ভর্তি দীর্ঘ আকৃতির জাল নিয়ে চোরা শিকারিরা আসেন এই বাদুড় শিকার করতে। ইতিমধ্যে কয়েকবার গ্রামবাসীকে ডেকে জড়ো করে চোরা শিকারিদের তাড়িয়ে দিলেও অনেকে আবার এটাকে বাড়তি ঝামেলা মনে করে এড়িয়ে যান বলে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে বাঁশগ্রাম ইউপি সদস্য কামরুজ্জামান বাচ্চু মোল্লা জানান, প্রাচীন আমল থেকেই এ এলাকায় উঁচু উঁচু গাছের ডালে বাদুড়গুলো আশ্রয় নিয়ে আসছে। তবে চোরা শিকারি আর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাদুড়ের সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেলেও এখন কবরস্থানের বাগানেই অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। সারা দিন কিচিরমিচির শব্দে বাগানের চারপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে এবং সন্ধ্যা হলেই খাবারের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বাদুড়ের দল।

নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মতিউর রহমান বলেন, ‘বাদুড় পাখি হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত এটি একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। বাদুড়ই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যে উড়তে পারে। বাদুড় কিছু রোগের জীবাণু বহন করলেও পরাগায়ণ সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রাণী বাদুড়ের নিরাপদ আবাসস্থলগুলো ধরে রাখতে স্থানীয়দের সহযোগিতার পাশাপাশি এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর