বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

তালিকায় সরকারি কর্মকর্তা থেকে শিক্ষক

বাড়ছে যৌন নির্যাতন

জিন্নাতুন নূর

তালিকায় সরকারি কর্মকর্তা থেকে শিক্ষক

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনজুর হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন এক কলেজছাত্রী। ওই ছাত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া মনজুর হোসেনকে আইনি নোটিসও পাঠিয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন। লিখিত অভিযোগে কলেজছাত্রী জানান, ২০২১ সালে মো. মনজুর হোসেনের সঙ্গে তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয়। বিয়ের কথা বলে ইউএনও তার সরকারি বাসভবনে ডেকে নিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। এরপর সেই ছাত্রীর পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হলে তিনি ইউএনওকে বিয়ের জন্য চাপ দেন। ইউএনও টাঙ্গাইল শহরের পাওয়ার হাউসের কাছে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ওই ছাত্রীর সঙ্গে দুই মাস থাকেন। এরপর মেয়েটিকে নিয়ে ভারতে ঘুরতে যান। সেখানে মেয়েটি জানতে পারেন মনজুর হোসেন বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। এরপর মুঠোফোন থেকে মনজুর হোসেন তাদের দুজনের কথোপকথন ও ভিডিও মুছে ফেলেন। আর বিষয়টি কাউকে জানালে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। দেশে ফিরে মেয়েটিকে এড়িয়ে চলেন ইউএনও।

কয়েক মাস আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন এক ছাত্রী। এ ঘটনার বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির কাছে গত বছর ২৬ ডিসেম্বর আবেদন জমা দিয়েছেন তিনি। সেই ভিকটিমের অভিযোগ, ২০১৯ সালের ৮ নভেম্বর ওই শিক্ষক ফোন করে তাকে ব্যক্তিগত কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন। সেখানে গেলে তাকে যৌন হয়রানি করেন। বিষয়টি বিভাগের চেয়ারম্যানকে জানানোর পর উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া বিচার করা সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ওই ছাত্রী এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। সেই ছাত্রী আরও জানান, ঘটনার পর অভিযোগ করতে চাইলে সহপাঠীদের মাধ্যমে তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হয়।

চলতি বছর নাটোরের বড়াইগ্রামে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মাদরাসা অধ্যক্ষ হযরত আলীকে (৬০) গ্রেফতার করে র‌্যাব। ১৮ ফেব্রুয়ারি উপবৃত্তি-সংক্রান্ত কাগজপত্রে ভুল আছে বলে মোবাইল ফোনে সেই ছাত্রীকে মাদরাসায় ডেকে নিয়ে আসেন অধ্যক্ষ। এ সময় ওই ছাত্রী আরেক সহপাঠীকে নিয়ে মাদরাসায় যায়। অধ্যক্ষ তার সহপাঠীকে ১০০ টাকা দিয়ে দোকান থেকে বিস্কুট-চানাচুর কিনতে পাঠান। এ সুযোগে অধ্যক্ষ ওই ছাত্রীকে জাপটে ধরে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনা স্থানীয় তিনজন প্রতিবেশী জানালা দিয়ে দেখে ফেলেন। পরে অধ্যক্ষ সেই ছাত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে এ ঘটনা কাউকে জানালে তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ওই কর্মকর্তার শাখায় তার অধীনে কর্মরত একজন নারী সহকর্মী লিখিতভাবে এ অভিযোগ করেন। অভিযোগ পাওয়ার পর রফিকুল ইসলাম নামে ওই কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে সংসদ সচিবালয়। ২৮ মার্চ সংসদ সচিব বরাবর ওই নারী লিখিত অভিযোগ করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০-১২ বছর আগে এক শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা সামনে আসে। সে সময় শিক্ষার্থীরা এ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেও বিচার পান না। আর বিচার চাইতে গেলে তাদের নানা রকম হুমকির মুখে পড়তে হয়। কারও থাকে চাকরি হারানোর ভয়, কেউ কেউ শিক্ষাজীবন নিয়ে আতঙ্কে থাকেন আবার কেউ পরিবার ও লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি লুকিয়ে রাখেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা যে আগে ঘটেনি এমন নয়, আড়ালে-আবডালে ঠিকই ঘটেছে কিন্তু এখন এটি এক ধরনের মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভালোমন্দ ও নৈতিকতার শিক্ষা আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকেই পাই। কিন্তু একজন শিক্ষকের মাধ্যমে যখন শিক্ষার্থী যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তখন তার আদৌ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আছে কি না ভাবতে হবে। একজন শিক্ষকের মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়া উচিত। আবার প্রশাসনিকভাবেও নারীরা অনেকভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। কিন্তু সেটি তারা প্রকাশ করেন না। কারণ ঘরের বাইরে মেয়েদের বের হওয়ার সুযোগ কম আর ঘটনাটি পরিবারকে জানালে মেয়েদের বাইরে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্য বেশির ভাগ সময়ই যৌন হয়রানির শিকার মেয়েরা নীরবে এসব সহ্য করে যেতেন। কিন্তু এ বিষয়ে আগের চেয়ে মেয়েরা সোচ্চার হয়েছেন। ফলে এ ধরনের ঘটনাও এখন বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের এসব বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার কথা থাকলেও তারা কথা বলছে না। অথচ দেশে সত্যিকারের রাজনীতিবিদ থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গ্রামগঞ্জে এ ধরনের কুৎসিত ঘটনা আমাদের দেখতে হতো না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর