বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্তিপণের টাকায় গার্মেন্ট করার স্বপ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

অপহরণের টাকায় দক্ষিণবঙ্গে সবচেয়ে বড় গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করার ইচ্ছা ছিল মুফতি মামুন ওরফে ল্যাংড়া মামুনের। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান পা হারালেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে ছিলেন না তিনি। তবে এরই মধ্যে ভগ্নিপতির টাকা আত্মসাৎ, পটুয়াখালী শহরে একাধিক দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তিনি। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। রয়েছে দুটি টর্চার সেলও। পটুয়াখালীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শিবুলালকে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে অপহরণ করলেও টার্গেটে সফলকাম হতে পারেননি তিনি। গতকাল রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা ও গুলিস্তান এলাকায় অভিযান চালিয়ে পটুয়াখালীর ব্যবসায়ী শিবুলাল দাসকে অপহরণের মূল হোতা ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুনসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মূল হোতা ল্যাংড়া মামুনের সহযোগী পিচ্চি রানা, বিআরটিসির চালক জসীম উদ্দীন ও আশিকুর রহমান। এ সময় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহৃত প্রাইভেট কার, মোবাইল ফোন, গামছা ও ৪ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

গতকাল বেলা সাড়ে ১২টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিবির যুগ্ম-কমিশনার হারুন অর রশিদ, ডিবি গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান। গোয়েন্দা প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, মাওলানা হিসেবে মামুনের বাবার সুখ্যাতি ছিল। পঙ্গু এ ক্যাডারের ভয়ে এত দিন মুখ খোলেনি কেউ। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের নামে আরও একটি মাদক মামলা করা হবে। পটুয়াখালী জেলা শহরে মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান মামুন। তার অর্থের প্রধান উৎস মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এলাকার বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন মামুন। ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে শিবুলাল দাস গলাচিপায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিজের গাড়িতে করে পটুয়াখালী শহরের বাসায় ফেরার পথে চালকসহ নিখোঁজ হন। পরে দূরের একটি পেট্রোলপাম্পের কাছাকাছি পরিত্যক্ত অবস্থায় তার পাজেরো জিপটিকে উদ্ধার করে জেলা পুলিশ। পরদিন ১২ এপ্রিল রাতে হাত-পা ও মুখ বাঁধা বস্তাবন্দী মুমূর্ষু অবস্থায় ভুক্তভোগীকে পটুয়াখালী জেলা পুলিশ উদ্ধার করলেও জড়িতরা থেকে যায় অধরা। হাফিজ আক্তার বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের কাছাকাছি ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টস অফিসে বসে পরিকল্পনা সাজায় অপহরণকারীরা। এতে অংশ নেন ল্যাংড়া মামুন, পিচ্চি রানা, পাভেল ও বিআরটিসির চালক জসিম। পরে একাধিকবার মিটিং ও অপারেশনাল পরিকল্পনা করেন তারা।

 পিচ্চি রানার ইচ্ছা ছিল একাধিক ট্রাক কিনে ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে পরিবহন ব্যবসা শুরুর। আর চালক জসিম উদ্দিনের ইচ্ছে ছিল মুক্তিপণের টাকায় নিজস্ব বাস কেনার। রেন্ট-এ-কারের দালাল আশিক চেয়েছিলেন নিজের প্রাইভেট কার। মিটিংয়ে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে যোগ দিতেন জসীম উদ্দীন মৃধা ও তার ভাই গাড়ির দালাল আশিক মৃধা। আগাম ১০ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে এক সপ্তাহের জন্য গাড়ি ভাড়া করা হয়। এ ছাড়া অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগসহ অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করার জন্য সাভার থেকে কেনা হয় পাঁচটি বাটন মোবাইল ফোন। বেশি দাম দিয়ে কেনেন অন্যজনের নামে নিবন্ধন করা সিম। এরপর একটি খেলনা পিস্তল, দুটি সুইচ গিয়ার চাকু, তিনটি চাপাতি ও গরু জবাই করার একটি বড় ছুরি সংগ্রহ করেন তারা। একাধিক দিন রেকি করে ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টায় ফিল্মি স্টাইলে অপহরণ করা হয় শিবুলাল দাসকে।

রোমহর্ষক অপহরণ অপারেশন যেভাবে : ১১ এপ্রিল দুপুরে পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের কাছে মিলিত হয়ে কার কোথায় কী দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেন ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। আর ভুক্তভোগীর গতিবিধি জানানোর জন্য পিচ্চি রানা ও ল্যাংড়া মামুন মোটরসাইকেলে যান গলাচিপা ঘাটে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য পটুয়াখালী-গলাচিপা হাইওয়ে রোডের শাঁখারিয়ার নির্জন জায়গায় একটা প্রাইভেট কার ও একটা ট্রলি নিয়ে অবস্থান নেন তাদের পাঁচ সহযোগী।

ল্যাংড়া মামুনের নির্দেশে আগে থেকেই একটি ট্রাক্টর ভাড়া করেন চালক বিল্লাল। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেট কারটি নিয়ে চালক আশিক মৃধা, পাভেল, হাবিব, সোহাগ এই চারজন অবস্থান নেন। ল্যাংড়া মামুনের সংকেত পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে বিল্লাল ট্রলিটি নিয়ে সুকৌশলে ভুক্তভোগী শিবুলাল দাসের জিপের সামনে আড়াআড়ি করে অবস্থান নেন। পেছন থেকে অনুসরণ করতে থাকা চালক আশিক তার প্রাইভেট গাড়িটি দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির পেছনে অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। পরে আশিক প্রাইভেট কার ছেড়ে ভুক্তভোগী শিবুলাল দাসের গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। গাড়িতে উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ ও আশিক বেঁধে ফেলে তাদের। গামছা, টিস্যু পেপার ও স্কচ টেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চালাতে থাকে শারীরিক নির্যাতন। বরগুনার আমতলী এলাকার গাজীপুরায় গিয়ে ভুক্তভোগীর জিপ থেকে তাদের তোলা হয় ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেট কারটিতে।? সেখানে দুজনকেই বেঁধে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢোকানো হয়। আর ভুক্তভোগীর জিপটিকে আমতলীর একটি ফিলিংস্টেশনে ফেলে আসে তারা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা পটুয়াখালীর বাঁধঘাট এলাকায় ভিকটিমদের বহনকারী গাড়ি বুঝে নেন। এইচডি রোডের নিজস্ব মেশিনঘর কাম টর্চার সেলে নেওয়া হয় তাদের। পরে নিয়ে যাওয়া হয় এসপি কমপ্লেক্স সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্থায়ী সেলে। রাতভর চলে নির্যাতন। পরদিন রানার নির্দেশে বিল্লাল ভুক্তভোগীর সিম থেকে ভিকটিমের স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। মুক্তিপণের টাকা না দিলে এবং বিষয়টি পুলিশকে জানালে শিবুলালকে হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন অপহরণকারীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর