শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বজ্রপাতে মৃত্যু আতঙ্ক

২০ দিনেই গেল ২০ প্রাণ, ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা

জিন্নাতুন নূর

সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন এ তিন মাস দেশে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত বজ্রপাতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর মার্চ থেকে জুন চার মাসে বজ্রপাতে ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারও বজ্রপাতের মৌসুমে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটবে। সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বজ্রপাত থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রহণ করা হয়েছে ‘তাল গাছ প্রকল্প’। এত কিছুর পরও বজ্রপাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যাচ্ছে না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে মোট ২ হাজার ৭৮৫ জনের বজ্রপাতে মৃত্যু হয়। আর আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যে, বজ্রপাতের কারণে বছরে গড়ে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যে, চলতি এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত বজ্রপাতে মোট ২০ জনের মৃত্যু হয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী এপ্রিলে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিন দিন বজ্রবৃষ্টির আশঙ্কা আছে। আর অন্য এলাকায় তিন থেকে পাঁচ দিন বজ্রবৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, সিলেটসহ বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনাও বেশি ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আগে শহর-গ্রামে যে-সংখ্যক উঁচু গাছ ছিল তা এখন কমে এসেছে। এজন্য বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘের ধরনেও পরিবর্তন আসছে। যখনই মাথার ওপর গভীর কালো মেঘ দেখা যাবে তখনই বুঝতে হবে এখানে বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। আর খোলা জায়গায় কোথাও আশ্রয় না থাকলে নিজেকে গুটিয়ে বসতে হবে। একইভাবে হাওর বা নদীতে বসে থাকলেও গুটিয়ে বসতে হবে। সাধারণত মে মাসে বরাবরই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি থাকে। মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে কৃষকের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই বুঝতে পারেন না বজ্রপাতের সময় কী করবেন। এজন্য এ বিষয়ে যত বেশি প্রচার চালানো হবে ততই ক্ষতির পরিমাণ কমবে। সরকারের পক্ষ থেকে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে তাল গাছের চারা রোপণ করা হলেও এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়।

বজ্রবৃষ্টি শুরু হলে তা ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময় সংশ্লিষ্টরা মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে বলেছেন। একান্ত প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে বলেছেন। টিনের চালা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার, ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। এ ছাড়া বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি ও ফ্রিজ ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে বলেছেন।

সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে যদি বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন করা যায় তাহলে কিছুটা উপকার হবে। কিন্তু শুধু ছাউনি বানিয়ে কোনো লাভ হবে না। দেশে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি কৃষক মারা যাচ্ছেন। সাধারণত কৃষক গরমে কৃষিকাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না, তারা বৃষ্টির সময় কাজ করতে আগ্রহী। বৃষ্টি পড়া শুরু হলে কৃষকের অনেকে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান কিন্তু এতে প্রাণহানির ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এজন্য দেশের হাওরাঞ্চলে কৃষকের জন্য বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপন জরুরি। আমরা দেশি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এ স্থাপনা তৈরি করতে পারি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর এবং দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘আগের তুলনায় বাংলাদেশে বজ্রপাত যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে একই সঙ্গে এতে মানুষের মৃত্যুর হারও বেড়েছে। আগের চেয়ে উন্মুক্ত স্থানে এখন মানুষ বেশি চলাচল করে। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা মেটালিক বস্তু যেমন মোবাইলে বজ্রপাতে ক্ষতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ যেহেতু বন্ধ করা সম্ভব নয় এজন্য এ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে বজ্রপাত নিরোধক অ্যান্টেনা ব্যবহার করা যেতে পারে।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার “হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট” নামে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মূলত দেশের হাওর এলাকার যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেখানে বজ্রপাতের ধরন দেখা হবে। এসব এলাকায় ঘরবাড়ি না থাকায় কেউ বজ্রপাতের সময় আশ্রয় নিতে পারে না। ঝুঁকি বেশি থাকায় এজন্য এ হাওর এলাকা ঘিরেই সরকার প্রথম প্রকল্প নিতে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ভৈরবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এসব এলাকায় কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হবে। সেখানে কিছু বজ্রপাত প্রতিরোধক দন্ড স্থাপন করা হবে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ যেখানে মাঠের পরিমাণ বেশি এবং আশ্রয় নেওয়ার স্থান নেই সেসব এলাকায় আরও কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’

জানা যায়, বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার জন্য বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় ‘লাইটার অ্যারেস্টার’-সংবলিত বজ্রপাত নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি বা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। হাওর এলাকায় ১ কিমি পরপর ১ হাজার বজ্রপাত নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি নির্মাণ করা হবে। বজ্রপাত থেকে কৃষকসহ অন্যদের রক্ষায় কৃষি মন্ত্রণালয় ২৩১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। একই রকম প্রকল্প নিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এ দুই প্রকল্পের আওতায় বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন, মোবাইল অ্যাপ, মোবাইল ভয়েস ও মোবাইল টেক্সট মেসেজের সাহায্যে বজ্রপাত আঘাত হানার আগে কৃষকসহ অন্যদের সতর্ক করা হবে। বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ও ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের রিসার্চ ফেলো প্রকৌশলী মো. মনির হোসেন বলেন, ‘সরকার যেসব প্রকল্প নিয়েছে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার জন্য সবার আগে কৃষকের মাঠকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে কৃষি অধিদফতরের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। এ ব্যাপারে তারাও কাজ করতে আগ্রহী কিন্তু কাজটি কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা রয়েছে। বজ্রপাত নিরোধক পোর্টেবল ডিভাইস বানানো উচিত। মাঠে যদি কৃষক প্লাস্টিকের গামবুট পরে যান তাহলে ঝুঁকি কমে যায়। বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার যে প্রযুক্তি তা দেশেই তৈরি করা সম্ভব। কৃষকের জন্য মাঠ পর্যায়ে পোর্টেবল বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা করতে হবে। এতে খরচও কম।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর