শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

পানির নিচে সোনার ফসল দিশাহারা হাওরের কৃষক

কোথাও কোথাও ডুবে আছে ফসল - কোথাও বাঁধ ভাঙার আতঙ্ক

প্রতিদিন ডেস্ক

পানির নিচে সোনার ফসল দিশাহারা হাওরের কৃষক

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার মেদির হাওর, আকাশি হাওর, আটাউড়ি বিল, বালিয়া বিলসহ বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমির মাঠ পানির নিচে তলিয়ে গেছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

হাওরাঞ্চলে একের পর এক হাওরডুবির ঘটনায় দিশাহারা কৃষক। কোথাও পানির নিচে তলিয়ে গেছে উঠতি ফসল, কোথাও ডুবন্ত অপরিপক্ব ধানই কাটা হচ্ছে। আবার কোথাও বাঁধ ভেঙে নতুন করে ফসল ডুবে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছেন কৃষক। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সুনামগঞ্জ : ঢলের পানিতে ফসলডুবির ঘটনায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের কৃষক। এ উপজেলার দাড়াখাল পাঠার হাওরে ৫ কেদার (৩০ শতকে ১ কেদার) জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন পাড়ারগাঁও গ্রামের কৃষক আবুল খয়ের। বাড়ির একটি গরু বিক্রি করে তিনি খরচের জোগান দেন। আশা ছিল খেতের ধান তুলে একটি গাভি কিনবেন। ধান উঠলে তাঁর আর বাইরে থেকে চাল কিনতে হবে না। ঘরের ধান দিয়ে চারটে ভাত খেতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সে আশায় গুড়ে বালি। বৃহস্পতিবার বিকালে কোন্দানালা এলাকায় বাঁধ ভেঙে হাওরটি তলিয়ে গেছে। হাওরের অন্তত ৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন জগন্নাথপুর, শান্তিগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার কৃষক। উজানে পাহাড়ি ঢলের পানিতে সোনার ফসল ডুবে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন আবুল খয়েরের মতো কৃষকরা। শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সীতাংশু রঞ্জন ধর বলেন, ‘হাওরে তিন উপজেলার অন্তত ৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এসব ধান রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় কৃষক ক্ষুব্ধ।’ হাওর বাঁচাও আন্দোলন জগন্নাথপুর উপজেলার যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুর রহমান বলেন, ‘ছয়টি হাওরের ফসল হারিয়ে উপজেলার কয়েক শ কৃষক দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। দ্রুত তালিকা করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো দরকার।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজেদুল ইসলাম দাবি করেন, ছোট ছোট কয়েকটি হাওরের বাঁধ উপচে সামান্য ক্ষতি হলেও বড় হাওরগুলো এখনো টিকে আছে। তিনি বলেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে হাওরের ধান কাটা চলমান। তিন-চার দিনের মধ্যে কৃষকের সব ফসল ঘরে উঠবে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ঢাকার মতিঝিলে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন বিজয় ঋষি। করোনায় তাঁর কপাল পোড়ে। নাসিরনগর উপজেলার কামারগাঁও গ্রামের বাড়ি ফিরে জমি বর্গা নেন। আশায় ছিলেন ভালো কিছুর। কিন্তু বিধিবাম! মেদির হাওরে থাকা সেই ১৫ কানি ধানি জমি তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। বিজয়ের চিন্তা এখন ধারদেনা নিয়ে। এ ছাড়া রূপন দাসের সংসার চলে মাছ ধরে আর জমির ফসল বিক্রির টাকায়। একমাত্র ছেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় বাড়তি খরচের চিন্তা। তবে ধানের ফলন ভালো হওয়ায় বেশ আশায় ছিলেন। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। কাটার আগ মুহূর্তে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তার কথা স্ত্রীকে বলতে গিয়ে চোখ ছলছল করছিল রূপনের। বিজয় আর রূপনের মতো নাসিরনগরের ২ হাজারের বেশি কৃষকের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। উপজেলার মেদির হাওর, আকাশি হাওর, আটাউড়ি বিল, বালিয়া বিলসহ বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমির মাঠ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনা : ধনু নদে পানি বেড়ে যাওয়ায় হুমকিতে পুরো হাওরাঞ্চল। পাহাড়ি ঢলে ২০ দিন ধরে ধনুর পানি বৃদ্ধির ফলে বাঁধ ভাঙার ভয়ে আছেন কৃষক। এদিকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নদের পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল দুপুরে কমে ২৭ সেন্টিমিটারে এসেছে। কিন্তু শঙ্কা কাটেনি হাওরবাসীর। ধনু নদের পাড়ে খালিয়াজুরী উপজেলার বিস্তীর্ণ হাওর। হাওরের ফসল রক্ষার জন্য এ নদের পাড়ে উপজেলার ৫৫ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধের ৭ কিলোমিটারের কীর্তনখোলা বাঁধে দেখা দেয় ভাঙন।

যে বাঁধের আওতায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি শুধু কৃষি বিভাগের তথ্যমতেই। পুরোটাই পড়ে যায় হুমকিতে। গেল ২ এপ্রিল ভারতের পাহাড়ি ঢলে বাঁধের কয়েক স্থানে ধসে যায় মাটি। আর এ মাটি ভরাট করতে কৃষক স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কাটেন। তার পরও দফায় দফায় ধস নামে একই বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বাঁধ মেরামত অব্যাহত থাকে। এদিকে কাঁচা-আধাপাকা ধান কাটতে শুরু করেন কৃষক। ফলে ধানের ফলন পরিপক্ব না হওয়ায় উৎপাদন কমে আসে। দাম কমে যায় আশঙ্কাজনক। তার পরও যতটুকু রাখা যায় তাতেই লাভ মনে করে দিনরাত এক করে ধান কাটতে থাকেন কৃষক। তবে কৃষক বারবার যা বলছেন তা হলো- প্রতি বছরই এ বাঁধের ভাঙন দেখা দেয়। পিআইসি দিয়ে বাঁধ করানো হয়। তখন কেন স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এভাবে তদারকি করে না? তাঁরা আরও বলেন, এ বাঁধের কাজ নভেম্বরে শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু তারা কাজই শুরু করে ফেব্রুয়ারিতে। যে কারণে মাটি বসতে সময় নেয়। এদিকে চৈত্রেই ঢলের পানি চলে এসেছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তার মধ্যে হাওরাঞ্চলে ৪০ হাজার ৯ হেক্টর। শুধু খালিয়াজুরীতেই প্রায় ২০ হাজার হেক্টর।

সর্বশেষ খবর