রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

হাওরাঞ্চলে এবারও বিপর্যয়

ধান কাটার জন্য মিলছে না শ্রমিক, ফলন হারানো কৃষক দিশাহারা

প্রতিদিন ডেস্ক

হাওরাঞ্চলে এবারও বিপর্যয়

ফি বছরের মতো এবারও হাওরাঞ্চলে নেমে এসেছে বিপর্যয়। একে তো ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে আবাদি ফসল, তার ওপর তলানো ধান কাটতে মিলছে না শ্রমিক। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের ফসল। এভাবে ফসল হারিয়ে অনেক জায়গায়ই দিশাহারা অবস্থায় দিন গুনছেন কৃষক। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ-

কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের হাওরে এবার বোরো আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে। উজানের ঢলে পানিতে তলিয়ে গেছে ৭৫০ হেক্টর জমির ধান। ফসলহানির আশংকায় কৃষক আধাপাকা ধান কাটছেন। শ্রমিক সংকটে সেটাও এখন ব্যাহত হচ্ছে।

প্রায় প্রতিবছরই ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলা থেকে ধান কাটার দাওয়ালিরা (শ্রমিক) কিশোরগঞ্জে আসেন। কিন্তু এবার আগাম বন্যার কারণে অন্যবারের তুলনায় অনেক কম শ্রমিক এসেছেন হাওরে। ইটনা উপজেলার মৃগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দারুল ইসলাম জানান, হাওরের বেশির ভাগ জমির ফসল এখনো আধাপাকা। এর পরও ফসলহানির আশংকায় আধাপাকা ধানই কাটছেন অনেকে। জমিতে পানি ঢুকে যাওয়ায় এক দিনের কাজে তিন দিন সময় লাগছে। তিনি আরও জানান, হাওরের ধান কাটার শ্রমিক আসে বিভিন্ন জেলা থেকে। অন্যবারের তুলনায় এবার কম এসেছে শ্রমিক। তাছাড়া স্থানীয় যেসব শ্রমিক ধান কাটেন, তাদের বেশির ভাগই নিজের জমির ফসল তোলা নিয়ে ব্যস্ত। জমিতে পানি থাকায় শ্রমিকের মজুরিও বেশি দিতে হচ্ছে। গত ৩ এপ্রিলের পর থেকে উজানের ঢলে নেমে আসা পানিতে তলিয়ে গেছে হাওরের নিচু জমি। কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জেলায় ৭৫০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইটনা উপজেলায়। এ উপজেলাতেই তলিয়ে গেছে ৩৭০ হেক্টর জমির ফসল। ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল সাহা বলেন, বাঁধগুলো এখনো সুরক্ষিত আছে। যদি পানি আর না বাড়ে, তবে কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। তবে যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে বাঁধ ছাড়াই বিভিন্ন দিক দিয়ে অল্প অল্প করে হাওরে পানি প্রবেশ করছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১৩ উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর অঞ্চলেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি। অধিদফতরের উপ-পরিচালক ছাইফুল আলম জানান, গতকাল পর্যন্ত ৫৩ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। বোরো মৌসুমে হাওরে ৯০ হাজারের মতো শ্রমিকের প্রয়োজন। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে শ্রমিক রয়েছে ৬০/৭০ হাজার। আর অনিয়মিত শ্রমিক ২০/৩০ হাজার। ‘এবার করোনায় চলাচলে বাধা নিষেধ না থাকায় শ্রমিকদের আসতে কোনো বাধা নেই’ উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, দূরের শ্রমিকরা হাওরে আসছেন। আগামী ১৫/২০ দিনের মধ্যে পুরো ধান কাটা সম্ভব হবে।

নেত্রকোনা : নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে ধানের কাক্সিক্ষত ফলন না পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন আপামর কৃষক। এই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ধান কাটতে আসা শ্রমিকরাও। আগাম ঢলে ফসল তলিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে আধা পাকা ধান কাটায় এমন ক্ষতিতে পড়েছেন চাষিরা। তার ওপর ফসল কেটে শ্রমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষকসহ শ্রমিকরা।

হাওর ঘুরে দেখা গেছে, টানা কয়েক সপ্তাহের পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরীর ধনু নদসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গেছে নদী তীরবর্তী কয়েক শ হেক্টর ফসলি জমি। হুমকির মুখে পড়েছে ছোট বড় বেশ কটি ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ। যদিও গত দুই দিন ধরে ধনু নদের পানি কিছুটা কমছে। তার পরও গতকাল দুপুর পর্যন্ত বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যে কারণে শেষ রক্ষার ভয় এখনো রয়েছে। যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে ফসলডুবির আশঙ্কায় এরই মধ্যে আধা-পাকা ধানই কেটেছেন হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ চাষি। প্রায় ৭০ ভাগ ধান কেটে ফেলেছেন কৃষক। ধানের ফলন হয়েছে অর্ধেক। তার ওপর চিটা হয়ে গেছে ধান। এমন দুর্যোগের মাঝে ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন না তারা। এই অবস্থায় শুধু কৃষকরাই নন, চরম বিপাকে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাওরে ধান কাটতে আসা শত শত শ্রমিক।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ এফ এম মোবারক আলী ধানের জাত বদলের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ২৮ ব্রি ও ২৯ ব্রি ধানের জাতের বদলে ৮৮ এবং ৮৯ জাতের ধান রোপণ করা উচিত। ২৮ ধানের বয়স হয়ে গেছে ২৬ বছর। যে কারণে ফলন এখন কম হবে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এগুলোর কমে গেছে। সেই সঙ্গে প্রকৃতিকগতভাবেই ১০ থেকে ১৫ ভাগ ধানে চিটা হয়ে যাবে। কাজেই চিটা পাকিয়ে কাটলে এগুলো ঝরে যাবে। ২৮ ব্রি ধান চাষ করতে থাকলে দিন দিন ক্ষত্রিগ্রস্তই হবেন কৃষক। তাই আগামীতে বিকল্প ধান ব্রি ৮৮, ব্রি ৮৯ চাষ করা উচিত।

হাওরাঞ্চলের আবাদ ত্রিমুখী বিপদের মধ্যে উল্লেখ করে তিনি জানান, বেশি আগাম লাগালে কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হবে, দেরিতে হলে আগাম ঢলে তলিয়ে যাবে। আবার শর্ট ডিওরেশনের হলে ফলন কম হবে। কাজেই ধনু নদের পাড়ে কির্তনখোলা বেড়িবাঁধ স্থায়ী করার বিকল্প নেই।

সর্বশেষ খবর