বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

নিউমার্কেটে সংঘর্ষে নিহতদের পরিবারের পাশে বসুন্ধরা গ্রুপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিউমার্কেটে সংঘর্ষে নিহতদের পরিবারের পাশে বসুন্ধরা গ্রুপ

নিউমার্কেটে সংঘর্ষে নিহত নাহিদ ও মুরসালিনের পরিবারের সদস্যদের হাতে গতকাল অর্থ সহায়তার চেক তুলে দেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কদিন বাদে পবিত্র ঈদুল ফিতর। দেশের মানুষ যখন ঈদ উদ্যাপনে নানা পরিকল্পনা ও কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন নিউমার্কেট সংঘর্ষে নিহত ডেলিভারিম্যান নাহিদ ও দোকান কর্মচারী মুরসালিনের পরিবারে চলছে মাতম। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় বিধবা হয়েছেন নাহিদের স্ত্রী শিলা মণি। অন্যদিকে বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে মুরসালিনের দুই শিশু সন্তান। স্বজন হারিয়ে শোকে বিহ্বল অসহায় এ দুই পরিবারকে ২০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ।

গতকাল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিহতদের পরিবারের হাতে আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ইমদাদুল হক মিলন, বসুন্ধরা গ্রুপের গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা মো. আবু তৈয়ব এবং নিহত নাহিদ ও মুরসালিনের পরিবারের সদস্যরা। মৃত নাহিদের বাবা নাদিম মিয়াকে ৩ লাখ, মা নারগিস আক্তারকে ৩ লাখ ও নাহিদের স্ত্রী শিলা মণিকে ৪ লাখ টাকা অর্থমূল্যের চেক প্রদান করা হয়। অন্যদিকে নিহত মুরসালিনের মা নুরজাহান বেগমকে ৩ লাখ ও স্বামী হারিয়ে দুই শিশু সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়া মুরসালিনের স্ত্রী অনি আক্তার মিতুকে দেওয়া হয় ৭ লাখ টাকার চেক। মুরসালিনের বাবা বেঁচে না থাকায় চেকটি মিতুর অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য তার বাবা মো. মকবুলকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, নিউমার্কেটের ঘটনার পর গণমাধ্যমে নাহিদ ও মুরসালিনের পরিবারের অসহায়ত্বের বিষয় জানতে পারেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। মুরসালিনের মেয়ের ঈদের জামা চাওয়ার বিষয়টি শুনে তিনি কষ্ট পান। এর পরই তিনি দুই পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

সহায়তার অর্থ গ্রহণের সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই পরিবারের সদস্যরা। সে কান্নায় স্বজন হারানো বেদনার পাশাপাশি ছিল বেঁচে থাকার আশা। চোখ মুছতে মুছতে নাহিদকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করে শিলা মণি বলেন, ‘বাসার দেয়ালে নাহিদ নিজের নাম লিখে গিয়েছিল। সারা দিন ওই লেখার দিকে তাকিয়ে থাকি। বিকালে আমাকে নিয়ে মার্কেটে যাবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু মানুষটা আর ফিরে এলো না। যে চলে গেছে তাকে তো আর পাব না। তার পরও এ সহায়তা পাওয়ায় আমার অনেক উপকার হলো। বসুন্ধরা গ্রুপ পাশে থাকায় আবার বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছি।’

নাহিদের মা নারগিস আক্তার বলেন, ‘তিন সন্তানের মধ্যে নাহিদ ছিল সবার বড় ও উপার্জনক্ষম। মেজ ছেলের বয়স সাত বছর ও ছোট ছেলের তিন বছর। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা ঋণ শোধ করতে হয়। নাহিদ দিত সাড়ে ৭ হাজার টাকা। ছেলেটা যত দিন দুনিয়ায় ছিল তত দিন আমাদের কথাই ভেবেছে। মরে গিয়েও পাশে আছে। ছেলেকে হারিয়ে শুধু বুকের মানিকই হারাইনি, ঋণ শোধ নিয়েও বিপদে পড়েছিলাম। বসুন্ধরা গ্রুপের এ সহায়তায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। বসুন্ধরা গ্রুপকে আল্লাহ আরও বড় করুক।’

অল্প বয়সে বিধবা হওয়া পুত্রবধূ শিলার ব্যাপারে নাহিদের বাবা নাদিম মিয়া বলেন, ‘ছেলে হারিয়ে মেয়ে পেয়েছি। শিলা আমার কাছে মেয়ের মতো থাকবে। যদি কখনো বিয়ে করতে চায় বা কাউকে পছন্দ করে, সেই ব্যবস্থা করব।’ নাহিদের শ্বশুর ও শিলার বাবা ডালিম বলেন, ‘আমি চাই এ টাকা দিয়ে শিলা নিজের মতো করে কিছু করুক। স্বাবলম্বী হোক। কাজের মধ্যে ঢুকে গেলে হয়তো স্বামী হারানোর বেদনা কিছুটা কমবে।’

মুরসালিনের স্ত্রী মিতু বলেন, ‘আমার দুটি বাচ্চা। মেয়ের বয়স সাত বছর, ছেলের চার। বাসায় ফেরার সময় মেয়ের জন্য ঈদের জামা নিয়ে আসবে বলেছিল মুরসালিন। কিন্তু মানুষটা আর ফিরল না। বাচ্চারা বারবার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে। বাবার কাছে যেতে চায়। আমি কীভাবে ওদের বলব তোমাদের বাবা আর আসবে না? বাচ্চা দুটিকে নিয়ে কোথায় যাব, কী করব দিশা পাচ্ছিলাম না। আজ আমি অনেক খুশি যে বসুন্ধরা গ্রুপ আমার বাচ্চাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষা আমার নেই।’

মুরসালিনের মা নুরজাহান বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী নেই। মুরসালিন ছিল ভরসা। আমার হার্টের রোগ আছে। প্রতি মাসে দুই-আড়াই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। মুরসালিন কত কষ্ট করে সে টাকা জোগাড় করত। আমার ছেলেকে যারা মেরে ফেলছে আল্লাহ তাদের বিচার করবে। বসুন্ধরা গ্রুপ আমাদের অসহায়ত্ব অনুভব করে আমাদের খুঁজে বের করে এতগুলো টাকা সহায়তা দিয়েছে। দুই হাত তুলে দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাদের ভালো করেন। এ টাকায় আমার নাতি-পুতিরা বেঁচে থাকতে পারবে।’

মুরসালিনের শ্বশুর মো. মকবুল বলেন, ‘কেউ আমাদের খবর নেয়নি। বসুন্ধরা গ্রুপ খবর নিয়েছে। খুবই ভালো লাগছে। স্বামী হারিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে আমার মেয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে। বসুন্ধরা গ্রুপের এ সহায়তা আমার মেয়ে ও তার দুই সন্তানের বেঁচে থাকার বড় অবলম্বন হবে। আল্লাহ যেন এ মহৎ মানুষদের ভালো রাখেন।’

বসুন্ধরা গ্রুপ দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘করোনার সময় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশে উত্তরবঙ্গের ৫০ হাজার পরিবারকে এক মাসের খাবার দিয়েছি। গত শীতে দেড় লাখ কম্বল বিতরণ করেছি। প্রতি মাসে ২৫ লাখ, ৫০ লাখ, ১ কোটি টাকাও দিয়ে কাউকে ঘর তুলে দিচ্ছি, কাউকে দোকান দিয়ে দিচ্ছি, কাউকে ভ্যান গাড়ি কিনে দিচ্ছি। আড়াই শ-তিন শ ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছি। ১১ জন ছেলেমেয়েকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছি। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, সেলাই মেশিন দিয়ে যাচ্ছি। ভিতর থেকে ১ একটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করে যাচ্ছি বসুন্ধরার পক্ষ থেকে। এটা বাংলাদেশে একটি দৃষ্টান্ত।’

সর্বশেষ খবর