রবিবার, ১ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ঈদুল ফিতরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

ঈদুল ফিতরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

ঈদ শব্দটি শোনা মাত্রই ছোট বড় সবাই আনন্দিত হোন। নিজের দেহ-মনে কেমন যেন একটা ভালো লাগা অনুভব করে। বাস্তবিকই এই আনন্দ, এই উৎসব একজন মুসলমানের, একজন রোজাদারের। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি ‘আওদুন’ মূলধাতু হতে এসেছে। এর অর্থ ফিরে আসা, বারবার আসা। পরিভাষায় ঈদ বলতে আমরা উৎসব, পর্ব, আনন্দ ইত্যাদিকে বুঝি। ‘ফিতর’ অর্থ ফাটল, ভাঙন, ভাঙা ইত্যাদি। এক কথায় ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা না রাখা বা রোজা ভাঙার পর্ব বা উৎসব। ঈদুল ফিতর প্রতি বছরই যথাসময়ে আমাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে আসে এবং এদিনটিতে আমরা একটি মাস সুবহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় সম্ভোগে লিপ্ত না হওয়ার যে বিধান ছিল তা ভঙ্গ করি শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী। তাই এ দিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়। হজরত রসুল (সা.) এদিন সম্পর্কে বলেছেন, এদিনটিতে তোমরা রোজা রেখো না। এদিন তোমাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন। খাওয়া, পান করা আর পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে আনন্দ-উৎসব করার দিন। আল্লাহকে স্মরণ করার দিন। [মুসনাদ আহমাদ, ইবনু হিববান] শরিয়তের কত সুন্দর নিয়ম, রমজান মাসে দিনে সব ধরনের পানাহার হারাম ছিল। আর ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম। কেউ রোজা রাখতে চাইলেও তার অনুমতি নেই। উল্লিখিত হাদিসে রসুল (সা.) ঈদের দিন আনন্দের সীমারেখা বলে দিয়েছেন। আলোচ্য ঈদের রয়েছে ইতিহাস। রয়েছে ঐতিহ্য। প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে হিজরত করেন। আসলেন মদিনাতুল মোনাওয়ারায়। এখানে তিনি এক অন্য রকম পরিবেশ পেলেন। দেখলেন, মদিনাবাসীরা পারসিকদের শিক্ষা ও কালচারে প্রভাবিত হয়ে বসন্তের পূর্ণিমা রাতে ‘মেহেরজান’ আর হেমন্তের পূর্ণিমা রাতে ‘নাওরোজ’ নামক উৎসবে এমন সব আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত যা সুস্থ বিবেকবান লোকদের কাছে অগ্রহণীয়। প্রিয়নবী (সা.) মদিনাবাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন। এ দিনে তোমাদের আনন্দ-উল্লাসের কারণ কী? মদিনার নওমুসলিমগণ নবীজিকে জানালেন, আমরা জাহিলী যুগ হতে এ দুটি দিন এভাবেই পালন করে আসছি। মহানবী (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ এ দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন তোমাদের আনন্দ উৎসব পালন করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হলো ‘ঈদুল ফিতর’, অন্যটি হলো ‘ঈদুল আজহা’। তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে এ দুটি ঈদ বা উৎসব পালন করবে।’ [আবু দাউদ ও নাসায়ী]। উল্লিখিত লেখায় আমরা জেনে নিলাম দুই ঈদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আল্লাহর হুকুম পালন করার মাঝেই মুসলমানদের ও রোজাদারদের অনেক আনন্দ অনেক পাওয়া। সেই হুকুম নামাজ ও সেজদার মাধ্যমে হলে আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। আমরা ঈদের দিন আনন্দ শুরু করব আল্লাহর দুুই রাকাত ওয়াজিব নামাজের মাধ্যমে। ঈদুল ফিতরের নামাজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় সে ব্যক্তি সাফল্য অর্জন করেছে, যে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করেছে এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করেছে। অতঃপর নামাজ আদায় করেছে।’ [সুরা আ’লা : ১৪-১৫]। আহকামুল কোরআন নামক কিতাবে বলা হয়েছে, উল্লিখিত আয়াতে নামাজ আদায় করা দ্বারা ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের কথা বলা হয়েছে।’ এই আয়াত হতে ঈদুল ফিতরের প্রমাণ পাই। অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।’ [সুরা কাওছার : ২]। হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন- এ আয়াতটিতে ঈদুল আজহার নামাজ ও কোরবানির নির্দেশ দান করা হয়েছে। এই আয়াত ঈদুল আজহার বিষয়টি পরিষ্কার। তখন হতে সব মুসলিম উম্মাহ যথারীতি প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালন করে আসছেন। তবে এই ঈদ, আনন্দ, উৎসব পালন করতে হবে শরিয়তের নিয়মকানুন অনুযায়ী। খেয়াল রাখতে হবে মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদগণ কীভাবে ঈদ পালন করেছেন। আমরাও তাদের মতো ঈদ, আনন্দ উৎসব পালন করব ইনশা আল্লাহ।

ঈদের দিনে করণীয়-

১. রোজা না রাখা : ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম।

২. গোসল করা : ঈদের নামাজের পূর্বে গোসল করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযি.) হতে বর্ণিত, হজরত রসুলে করিম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক]।

৩. কিছু খাওয়া : রোজার ঈদে নামাজ পড়ার জন্য যাওয়ার পূর্বে কিছু আহার করার কথা হাদিসে আছে। বিশেষ করে হাদিসে খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় জিনিস খাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। হজরত আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রসুলে করিম (সা.) খেজুর না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। [বুখারি]।

৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা, ঈদের দিন আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা। ৫. সুন্দর পোশাক পরিধান করা। হজরত জাবির (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.)-এর একটি সুন্দর জুব্বা ছিল যা তিনি দুই ঈদে ও জুমার দিনে পরিধান করতেন। [বায়হাকি]।

৬. সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। হজরত ইবনু আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, শরিয়তে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করাকে ওয়াজিব করা হয়েছে। যা একদিকে ত্রুটি যুক্ত রোযাকে পবিত্র করে, অন্যদিকে এর দ্বারা অসহায়-নিঃস্বদের প্রয়োজন কিছুটা হলেও পূরণ হয়।

৭. পায়ে হেঁটে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাওয়া এবং এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আশা। হজরত সাঈদ ইবনু যুবাইর (রাযি.) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) এক রাস্তা দিয়ে ঈদের নামাজে যেতেন এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসতেন। (বুখারি)

৮. তাকবির বলা। তাকবির বলতে বলতে ঈদের নামাজ পড়ান জন্য যাওয়া। হজরত ইবনু উমর (রাযি.) হতে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত আছে যে, নবী করিম (সা.) ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাকবির বলতেন। তাকবির বলতে হবে এভাবে : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।

৯. ঈদের দিনে পারস্পারিক ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করা। এইভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় করা ‘যেমন তাক্বাববালুল্লাহা মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহ আমাকে ও আপনাকে কবুল করুন) ইত্যাদি।

১০. ঈদের নামাজ আদায় করা। ঈদের দিন ঈদের নামাজের পূর্বে অন্য কোনো নামাজ আদায় করা ঠিক নয়। হজরত ইবনু আব্বাস (রাযি.) বলেন : হজরত রসুল (সা.) ঈদের দিন বের হয়ে শুধুমাত্র ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। ঈদের নামাজের পূর্বে বা পরে (সঙ্গে সঙ্গে) নফল বা অতিরিক্ত কোনো নামাজ আদায় করতেন না। [বুখারি, মুসলিম ও তিরমিযি]।

১১. খুতবাহ শ্রবণ ও দুআ করা। ঈদের নামাজের পরে ইমাম সাহেব খুতবাহ প্রদান করবেন এবং মুসল্লিগণ তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবেন। এটি পালন করা ওয়াজিব। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদেরকে এমন একটি ঈদ পালন করার তাওফিক দান করেন যেখানে ধনী-গরিবের শ্রেণি ভেদ থাকবে না। সবাই মিলে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করে বলব, আলহামদুলিল্লাহে আলা কুল্লে হাল (সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা) এইভাবে ঈদ পালন করার মাধ্যমে আমাদের মাঝে জান্নাতি একটা পরিবেশ বিরাজ করবে ইনশা আল্লাহ। আমিন।

সর্বশেষ খবর