রবিবার, ১ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

অপরাধী চক্র নিয়ন্ত্রণই চ্যালেঞ্জ

♦ ঘরমুখো মানুষকে টার্গেট করে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য ♦ বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশনকেন্দ্রিক নানা বেশে সক্রিয় অপরাধীরা ♦ চলছে বিশেষ নজরদারি ♦ সতর্ক ১৫ হাজার পুলিশ র‌্যাব গোয়েন্দা

সাখাওয়াত কাওসার

ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বেড়েছে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। অন্য সব বছরের মতোই ঘরমুখো লোকজনকে টার্গেট করছে তারা। অর্থের পাশাপাশি ছিনিয়ে নিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ মালামাল। সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইকারীদের হাতে চিকিৎসক বুলবুলসহ আরও কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা ভাবিয়ে তুলছে সাধারণ মানুষসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশনকেন্দ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৫ হাজার সদস্যের নজরদারি চলছে। এর মধ্যে সাদা পোশাকের পাঁচ হাজার সদস্য তৎপর রয়েছেন। র‌্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নিরাপত্তার শঙ্কা কিংবা জনভোগান্তি তৈরি হতে পারে এমন সব কটি খাত বিবেচনায় রেখেই নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকগুলো অভিযানে সফলতাও এসেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যমতে, করোনা-পরবর্তী এই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এবার মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘরমুখো। একই সঙ্গে গত কয়েক বছরের  তুলনায় এবার অপরাধী চক্রের তৎপরতাও বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে তাদের গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও এবার অনেক বেশি। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকা থেকে ৮৪৪টি ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির ঘটনায় ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশি সেবা চেয়েছেন। এ হিসাবে রাজধানীতে মাসে ২৮১টি এবং দিনে ৯টি ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। ৮৪৪টি ঘটনার মধ্যে ছিনতাই হয়েছে ২০৭টি এবং চুরি-ডাকাতি ৬৩৭টি। এর মধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা জানুয়ারিতে ৭২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৭৩টি ও মার্চে ৬২টি। চুরি-ডাকাতি জানুয়ারিতে ২২০টি, ফেব্রুয়ারিতে ২২১টি ও মার্চে ১৯৬টি।

সাম্প্রতিক অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ ও র‌্যাব এসব চক্রের ২৭৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে অন্তত শতাধিক অজ্ঞান পার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। এ ছাড়া গ্রেফতার ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই বিরুদ্ধে চুরি, দস্যুতা, ডাকাতির প্রস্তুতি ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেফতারের সময় এদের কাছ থেকে দেশি অস্ত্র, ছোরা, চাকু, ক্ষুর, দা, রড, লোহার পাইপ, চেতনানাশক ওষুধ, মলমসহ ছিনিয়ে নেওয়া নগদ অর্থ জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া জাল টাকার কারবারিদের তৎপরতাও বেড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে অপরাধীদের তৎপরতা কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে অজ্ঞান পার্টি ও ছিনতাইকারীরা কিছুটা বেপরোয়া। তাদের নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির আটটি ক্রাইম বিভাগ তৎপর রয়েছে। যে কোনো বিপদে পুলিশ মানুষের পাশে রয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৪ এপ্রিল রাতে নারায়ণগঞ্জ সদরের সৈয়দপুরে অটোরিকশাচালক আপনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে অটোরিকশা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। পরে এ ঘটনায় সদর থানায় মামলায় হয়। ওই মামলায় ছিনতাইকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৭ মার্চ মিরপুরের কাজীপাড়ায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন দন্তচিকিৎসক বুলবুল আহমেদ। ঠিক একইভাবে ২০ ফেব্রুয়ারি ভোরে সায়েদাবাদ ব্রিজের ঢালে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান মোশারফ হোসেন নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এর বাইরেও দেখা যাচ্ছে অজ্ঞান পার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা ব্যস্ততম এলাকায়, অন্ধকার বাসস্ট্যান্ডে দলবদ্ধভাবে নিরীহ মানুষদের টার্গেট করে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, বিমানবন্দর ও মার্কেট ঘিরে তাদের তৎপরতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুর্বৃত্তরা টার্গেট করা ব্যক্তির ওপর চেতনানাশক প্রয়োগ করে অচেতন করার পর সবকিছু লুটে নেয়। কোনো কোনো চক্র আবার যাত্রী ও পথচারীদের খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক খাইয়ে অজ্ঞান করে। বিষাক্ত এসব উপাদান শরীরে প্রবেশের পর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। কেউ বাধা দিলে সঙ্গে থাকা ছুরি-চাকু দিয়ে দুর্বৃত্তরা আঘাত করছে।

১৬ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে প্রাণ যায় আবদুল হান্নান নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার। এর আগে কমলাপুর রেলস্টেশনে মোকসেদ আলী নামের এক বৃদ্ধ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে মারা যান। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১১ জন অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়া রোগী আসেন। পথচারী কিংবা পুলিশ সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, অতীত এবং সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে মাথায় রেখেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা সাজানো উচিত। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে বাহিনীর ঊর্ধ্বতনদের উচিত হবে বিভিন্ন ইউনিট চিফদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় রক্ষা করা।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে অপরাধিরা কিছুটা বেপরোয়া হয়েছে এটা সত্য। তবে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এবার সড়কের ভোগান্তি দূর করতে আমরা চেকপোস্ট করছি না। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেই নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজিয়েছি। বাসমালিকদের বলা হয়েছে বাস ছাড়ার আগে যাত্রীদের ভিডিও করার জন্য। হাইওয়ের নীরব চাঁদাবাজি ঠেকাতে নেওয়া হয়েছে সাদা পোশাকের বিশেষ টহল।’ তিনি বলেন, ‘বাস-ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি দূর করতে যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে আমাদের কন্ট্রোল রুমের নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য। প্রতিটি স্টেশনে আমরা কন্ট্রোল রুম করেছি যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য। বিশেষ করে রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বাড়ায় গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে।’

অভিযান গ্রেফতার : বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি এলাকার হাজী ভঙ্গি শাহ মাজারের সামনে থেকে পাঁচজন ডাকাতকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৭। র‌্যাব বলছে, এরা বড় ধরনের ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

র‌্যাব-৩-এর একাধিক দল শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত রাজধানীর সবুজবাগ, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, মুগদা, শাহবাগ, মতিঝিল, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর ও পল্টন এলাকা থেকে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাসহ ৩৩ জন চাঁদাবাজ ও আটজন ছিনতাইকারীসহ মোট ৪১ জন গ্রেফতার করে। এ সময় চাঁদাবাজির মাধ্যমে আদায় করা নগদ ১ লাখ ২ হাজার ৫৩৩ টাকা এবং মোবাইল ও ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব-৩ অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দীন বলেন, এরা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সবজি ও ফলের দোকান, ফুটপাথের অস্থায়ী দোকান, লেগুনা স্ট্যান্ড এবং মালবাহী গাড়ি থেকে অবৈধভাবে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ দোকানের মালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রত্যেক দোকানির কাছ থেকে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করে আসছে।

রমজানের শুরু থেকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান চলছে রাজধানীতে। চলতি মাসে রাজধানীর লালবাগ, হাজারীবাগ ও নিউমার্কেট এলাকা থেকে অর্ধশতাধিক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১১ এপ্রিল রমনা, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, পল্টন, শাহজাহানপুর, মতিঝিল, ওয়ারী ও শাহবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৫ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ১৯ এপ্রিল ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টির ৮২ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ২০ এপ্রিল শাহবাগ ও হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে চাকুসহ ১০ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৭ এপ্রিল উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে অজ্ঞান পার্টির সর্দার মো. মনির ওরফে মোনারুল ওরফে শসা মনিরকে (৩৫) গ্রেফতার করে র‌্যাব। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার হাজারীবাগ ও যাত্রাবাড়ী থানা এলাকা থেকে অজ্ঞান পার্টির ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ঈদের আগে অপরাধীরা নানা কৌশলে তৎপর রয়েছে। কিছুদিন ধরে বেশ কিছু ঘটনায় মনে হচ্ছে অজ্ঞান পার্টির উৎপাত বেড়েছে। সাধারণ যাত্রীদের টার্গেট করেই এরা অপকর্ম করে। অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বাড়ায় আমাদের অভিযানও বাড়ানো হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর