রবিবার, ৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র

১২০ কোটি টাকার মালামাল কেনায় হাজার কোটি গচ্চা!

♦ ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটের জেনারেটর সংস্কারে নজিরবিহীন কালক্ষেপণ ♦ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চিরতরে বিকল হওয়ার আশঙ্কা

শামীম আহমেদ

তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরকার ১৬ থেকে ২২ টাকা দরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনলেও সরকারি মালিকানাধীন সবচেয়ে সাশ্রয়ী কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সংস্কার কাজ ঝুলে আছে বছরের পর বছর। অথচ এ কেন্দ্র থেকে ৪০ পয়সার কম খরচে পাওয়া যায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ। কেন্দ্রটি সংস্কারে ১২০ কোটি টাকার মালামাল ক্রয়ে দরপত্র-পুনঃদরপত্রেই কেটে গেছে তিন বছরের বেশি। সংস্কারের অভাবে উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকের নিচে। উৎপাদন কমায় গত তিন বছরে সরকারের ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। একইসঙ্গে দেশের সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি চিরতরে বিকল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সূত্র জানায়, কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটের জরুরি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ২০১৮ সালে। ইউনিট দুটিতে জেনারেটরসহ মালামাল সরবরাহের জন্য ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) থেকে বার বার দরপত্র মূল্যায়ন করে অনুমোদনের জন্য ক্রয় কমিটিতে পাঠানো হলেও অজ্ঞাত কারণে তা বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমানে চতুর্থ দফা দরপত্রের মূল্যায়ন চলছে।

জানা গেছে, সরকারি মালিকানাধীন কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৪০ পয়সার কম। অন্যদিকে তেলভিত্তিক অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৬ থেকে ২২ টাকা দরে কিনছে পিডিবি, যা কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় ৪০ গুণ বেশি। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসে থাকলেও দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং চার্জ। বাড়তি খরচের এ বোঝা শেষ পর্যায়ে গিয়ে চাপছে ভোক্তার কাঁধে। বাড়ছে বিদ্যুৎ বিল। বাড়ছে সরকারের ভর্তুকি। তবুও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সংস্কার বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে। সূত্রমতে, কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা ২৩০ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ৬০ মেগাওয়াটের কম। বর্ষাকালে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা থাকলেও গত বছরের আগস্টে ভরা বর্ষায় উৎপাদন ছিল ১২৫ মেগাওয়াটেরও কম। ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটের প্রতিটির উৎপাদন সক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট হলেও উৎপাদন হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ মেগাওয়াট। তাও অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সংস্কারের অভাবে ইউনিট দুটি থেকে নিয়মিত গড়ে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হলেও গত তিন বছরে মোট ৭৮ কোটি ৮৪ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ কম পেয়েছে দেশ। ৪০ পয়সা করে এ কম উৎপাদিত হওয়া বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ৩১ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ১৬ টাকা দরে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটে কম উৎপাদিত হওয়া বিদ্যুতের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ২৬১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এতে সরকারকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বাড়তি গুনতে হয়েছে (উৎপাদন খরচ বাদে) ১ হাজার ২২৯ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

পিডিবি সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট জেনারেটরের মূল প্রস্তুতকারক জাপানের তোশিবা এনার্জি সিস্টেম অ্যান্ড সলিউশন করপোরেশন। এ কারণে ইউনিট দুটিতে জেনারেটরসহ মালপত্র সরবরাহ কাজের জন্য ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ডিপিএম (সরাসরি ক্রয়) পদ্ধতিতে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান আরও কম দামে কাজ করবে বলে ক্রয় কমিটিতে অভিযোগ দেয়। পরে তাদের কথায় ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফের দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে অভিযোগ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রই দাখিল করেনি। সাতটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করলেও যোগ্যতা না থাকায় ছয় প্রতিষ্ঠানই দরপত্র দাখিল করেনি। শুধু তোশিবা তাদের স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে দরপত্র দাখিল করে। ক্রয় কমিটি অনুমোদন না দেওয়ায় ফের তৃতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। এবারও তোশিবা ছাড়া অন্য কেউ দরপত্র দাখিল করেনি। সর্বশেষ চতুর্থ দফা দরপত্র আহ্বান করলে তোশিবা মনোনীত তিনটি ও একটি চাইনিজ কোম্পানি দরপত্র দাখিল করেছে। বর্তমানে দরপত্রের মূল্যায়ন চলছে।

সবচেয়ে সাশ্রয়ী সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দীর্ঘদিনে সংস্কার না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্ল্যান্ট চালু আছে। এখন পানি কম। পানি থাকলে সব ইউনিট চালাই। সংস্কার না করে দীর্ঘমেয়াদে চালানো সম্ভব নয়। সংস্কারের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়াধীন আছে।

কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. এ টি এম আবদুজ্জাহেরকে ফোন করলে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিট নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ আছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে চলছে। ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিট এখনো ৩০-৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষম। মোট ৩০ থেকে ৪০ মেগাওয়াট কম উৎপাদন হচ্ছে। এর বেশি লোড দিলে বসে যেতে পারে। ইউনিট দুটি সংস্কারে চতুর্থ দরপত্র মূল্যায়ন পর্যায়ে আছে। আগের তিনবার একক প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করায় অনুমোদন দেয়নি। এবার চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিপিআর অনুযায়ী একক দরপত্র গ্রহণের নিয়ম রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের অমূলক চিঠির ভিত্তিতে সংস্কার কাজ তিন বছরের বেশি ঝুলিয়ে রাখায় শুধু হাজার কোটি টাকা গচ্চাই দিতে হয়নি, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংস্কারের খরচও বাড়বে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর