সোমবার, ৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

অনলাইন গেমে ভয়াবহ আসক্তি

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও দৃষ্টিশক্তি, উদ্বিগ্ন অভিভাবক

জিন্নাতুন নূর

অনলাইন গেমে ভয়াবহ আসক্তি

চট্টগ্রামের চকবাজার থানার ডিসি রোডের ১০ম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোর মোবাইল গেম খেলতে নিষেধ করায় পাঁচ মাস ধরে আত্মগোপনে ছিল। বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্টে চাকরিও নিয়েছিল সেই কিশোর। সম্প্রতি ফেসবুকে বন্ধুত্বের ফাঁদ পেতে র‌্যাব সদস্যরা তার অবস্থান শনাক্ত করে। কিশোরটিকে উদ্ধার করে অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। র‌্যাব সদস্যরা জানান, পাবজিসহ বিভিন্ন গেম এবং নিষিদ্ধ পর্নোগ্রাফিতে অস্বাভাবিকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিল সেই কিশোর। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর দুপুরে বাসায় মোবাইলে ফ্রি-ফায়ার গেম খেলছিল  কিশোরটি। এ সময় তার বাবা-মা দেখতে পেয়ে শাসন করলে অভিমান করে মোবাইল রেখে বাসা থেকে পালিয়ে যায়।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভিডিও গেম খেলতে না দেওয়ায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ইয়ামিন নামের আট বছরের এক শিশু আত্মহত্যা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের পৌর এলাকার আলিয়াবাদ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, ইয়ামিন মায়ের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রায় সময় ভিডিও গেম খেলত। ঘটনার দিন সকালে গেম খেলতে মায়ের কাছে মোবাইল ফোন চায় ইয়ামিন। তার মা এ সময় পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে বলে ফোন না দিলে ইয়ামিন অভিমান করে বাড়ির একটি খালি কক্ষে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।

চক্ষু ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মোবাইল গেম খেলার বিষয়টি এখন আসক্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে অতিরিক্ত গেম আসক্তির কারণে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধা পাচ্ছে মানসিক বিকাশ। এর কারণে ছয় থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের চোখ ও মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনলাইন গেমিং আসক্তিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

করোনা মহামারি চলাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এবং বাইরে খেলার সুযোগ না পাওয়ায় বেশিরভাগ স্কুলপড়ুয়া শিশু ঘরে থেকে মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে। অনলাইন ক্লাসের কারণে শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার হার বৃদ্ধি পায়। এতে শিশু-কিশোরদের অনলাইন গেম খেলার সুযোগ তৈরি হয়। 

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মোবাইলসহ অন্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের আসক্তির ফলে শিশুর ক্ষতি ভয়ংকর পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এই সমস্যায় পড়ে প্রচুর অভিভাবক নিজের সন্তানকে চিকিৎসার জন্য আনছেন। ছোট শিশু থেকে শুরু করে শিশু-কিশোররাও এসব ডিভাইসে আসক্ত। এর ফলে শিশুরা লেখাপড়া বিমুখ হয়ে পড়ছে। অসামাজিক হয়ে পড়ছে। সর্বোপরি তাদের ব্যক্তিত্বে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে এবং তাদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। এ ধরনের শিশুর পরবর্তীতে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুুঁকি বেড়ে যায়। তার মতে, এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানকে কতটা সময় এ ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করতে  দেবেন তা ঠিক করতে হবে। সন্তান বায়না ধরলেই তাকে মোবাইলসহ অন্য ডিভাইস ব্যবহার করতে না দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় যেতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটানা দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে শিশুরা ক্ষীণ দৃষ্টি বা ‘মায়োপিয়া’তে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ আই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্যে, প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশু মায়োপিয়া’র সমস্যায় ভুগছে। অভিভাবকরা জানান, শিশুরা এখন ঘরের বাইরে খেলাধুলায় তেমন আগ্রহী নয়। বেশিরভাগ শিশুই ঘরে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনে মোবাইল গেম খেলায় আগ্রহী। বিশেষ করে ২ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা মোবাইল গেমে এতই  আসক্ত যে তাদের খাওয়ার সময় মোবাইল না দিলে খেতে চায় না, অতিরিক্ত জেদ দেখায়, সহিংস আচরণ করে এবং কান্নাকাটি করে। অনেক শিশু এ কারণে কথাও কম বলে। মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জাফরুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কাছে অভিভাবকরা যে শিশুদের নিয়ে আসছে তাদের অনেকেরই দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে পড়ায় তারা চোখে কম দেখছে। অতিরিক্ত মোবাইল ফোন আসক্তির জন্যই এমনটি হয়েছে। অভিভাবকদের আমরা এ ধরনের শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছি। আর তা না হলে চোখের মাইনাস পাওয়ার আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, দীর্ঘসময় মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারে শিশুর নিয়ার ভিশনের দূরত্ব কমে যায়। শিশুর দৃষ্টি তখন মাইনাসের দিকে চলে যায়। মোবাইল ব্যবহারে বর্তমানে অনেক শিশুর দৃষ্টি মাইনাসে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া মোবাইল রশ্মিও দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি করছে। মোবাইল ব্যবহারের সময় একটি দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়ায় এবং অন্য শারীরিক কসরত কমে যাওয়ায় শিশুর মেজাজও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মোবাইল গেম খেলা এক ধরনের মোহ। আবার শিশু-কিশোররা এখন খুব সহজেই মোবাইল গেম খেলার সুযোগ পাচ্ছে। অভিভাবকরা যখন বুঝতে পারেন যে তার সন্তান মোবাইল বা ভিডিও গেমে আসক্ত তখন আসলে দেরি হয়ে যায়। মোবাইল গেম খেলাকে এক ধরনের ‘মেন্টাল ডিসওর্ডার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই আসক্তি অন্যান্য আসক্তির মতোই। আর আসক্তির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো সবক্ষেত্রেই এক। একজন যখন আসক্ত হয়ে যায় তখন তার নার্ভাস সার্কিট এমন হয়ে যায় যে তখন সেটিই তাকে ডমিনেট করে; অন্যসব কিছু তখন সাবঅর্ডিনেট হয়ে যায়। তখন অন্য বুদ্ধি আর কাজ করে না। যখন গেম আসক্তরা খেলার সুযোগ পায় না তখন নেশা না করার মতো তার মধ্যে উইথড্র সিনটম তৈরি হয়। এই উইথড্র সিনটম শারীরিক না, মানসিক। একবার কেউ আসক্ত হলে তাকে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে সুস্থে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। অভিভাবকদের আগে থেকেই সন্তান গেমে আসক্ত হলো কিনা সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর