শিরোনাম
সোমবার, ১৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ভাঙছে যৌথ পরিবার, নষ্ট হচ্ছে পারিবারিক শৃঙ্খলা

জিন্নাতুন নূর

ভাঙছে যৌথ পরিবার, নষ্ট হচ্ছে পারিবারিক শৃঙ্খলা

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা নুসরাত জাহান। মাতৃত্বজনিত ছুটি শেষে সম্প্রতি অফিসে যোগ দিয়েছেন। তার কন্যাসন্তানের বয়স সাড়ে পাঁচ মাস। নুসরাতের স্বামী আসিফ ইকবাল একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। কাজে যাওয়ার আগে বনশ্রীর বাসা থেকে মেয়েকে নুসরাত রামপুরায় মায়ের বাসায় রেখে মগবাজারে কর্মস্থলে যান। কখনো মায়ের বাসাতেই থেকে যান। কিন্তু এভাবে অফিস-বাসা করতে গিয়ে নুসরাত ও তার স্বামীর বেশ কষ্ট হচ্ছে। ঘর থেকে ঘন ঘন বের হওয়ার কারণে বাচ্চার শারীরিক সুস্থতা নিয়েও এই দম্পতি চিন্তিত। নুসরাত আফসোস করে বলেন, ‘আমার বাবা অসুস্থ থাকায় মাকে বাসায় এসে থাকতে বলতে পারি না। আবার আসিফের বাবা-মা ফরিদপুরে তাদের ছোট ছেলেকে নিয়ে থাকেন। এ জন্য তাদের পক্ষেও ঢাকায় এসে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু পরিবারের সবাই মিলে একত্রে থাকলে আজ এ দুর্ভোগে পড়তে হতো না।’

নুসরাতের মতোই ঢাকায় বসবাসরত আরও অনেক দম্পতিকে এভাবে যৌথ পরিবারের অভাব অনুভব করতে হচ্ছে। অথচ খুব আগের কথা নয়, একসময় রাজধানীতেও যৌথ পরিবারের দেখা মিলত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং জনজীবনে ব্যস্ততা বাড়ায় এখন যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের প্রাধান্যই বেশি দেখা যাচ্ছে। গ্রামে এখনো যৌথ পরিবার প্রথা চালু থাকলেও ধীরে ধীরে তাও ভাঙতে শুরু করেছে। এতে পারিবারিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যত বাড়ছে মানুষ তত যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে একাকী বা ক্ষুদ্র পরিবারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। নিজের গোপনীয়তা রক্ষা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার জন্য অনেকেই এখন একক পরিবার গঠনে আগ্রহী। কিন্তু যৌথ পরিবারে একজনের বিপদ-আপদে অন্যদের পাশে পাওয়া গেলেও একক পরিবারে তা পাওয়া যায় না। আবার যৌথ পরিবারে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি এবং সব ভাইবোনের সহযোগিতায় শিশুরা বড় হয়ে ওঠে, যা একক পরিবারের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কেউ অসুস্থ হলেও যৌথ পরিবারের সদস্যরা যেভাবে দেখভাল করেন, একক পরিবারে সেই যত্ন পাওয়া যায় না। এ ছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ এবং শিশুর মানসিক বিকাশেও একক পরিবারের চেয়ে যৌথ পরিবারের অবদান বেশি। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার কারণে বৃদ্ধ মা-বাবাদের অনেকেরই এখন আশ্রয় হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলে-মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করে অনেকেই আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেখানে তারা নিজেদের অভিভাবকদের রাখতে চান না। আর সন্তানের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এই অভিভাবকদের অনেকের আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রমে। কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে বাকি জীবন একাকী কাটান।

শহরে যে ফ্ল্যাটবাড়িতে মানুষ ভাড়া থাকছে সেখানে দুই বেডরুমের ছোট বাসাগুলোতে থাকা বাসিন্দাদের বেশির ভাগই একক পরিবারের। ঢাকায় ভাড়া থাকা বাসিন্দাদেরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ একক পরিবারের সদস্য। ঢাকার বাইরে থেকে আসা বাসিন্দাদেরও উল্লেখযোগ্য মানুষ গ্রামের বাড়িতে পরিবারের অন্য সদস্যদের রেখে শুধু জীবিকার তাগিদে ঢাকায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। মোবাইল ফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই এখন বেশির ভাগ মানুষ তার কাছের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। বিয়ে, জন্মদিন বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এবং শোকের বাড়ি ছাড়া পরিবারের সব আত্মীয় এখন আর এক হন না।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের কারণে এখন যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। এর ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যৌথ পরিবার ভেঙে এখন একক পরিবার রূপান্তরের বিষয়টি বৈশ্বিক। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এখন ব্যক্তিত্ববাদের ওপর প্রাধান্য বেশি দেওয়া হচ্ছে। কাজ ও শিক্ষার জন্য মানুষ পরিবার থেকে আলাদা হচ্ছে। আবার যৌথ পরিবারে শেয়ারিংয়ের বিষয়টি যেমন ইতিবাচক, একইভাবে একজনের উপার্জনের অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে মতানৈক্যও থাকতে পারে। আমাদের দেশে বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার একসঙ্গে থাকার রেওয়াজ আছে কিন্তু দেশের বাইরে বয়স হলে অভিভাবকদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখা হয়। তবে বৈশ্বিক সংস্কৃতির খারাপ দিকটা না নিয়ে আমাদের ইতিবাচক দিকটা নিতে হবে। এ দেশে এখনো বৃদ্ধাশ্রমের সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। এ ব্যাপারে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। যৌথ পরিবার ভেঙে গেলে এর যেমন ভালো দিক আছে, আবার খারাপ দিকও আছে। অনেক দম্পতি আছেন, যারা এখন তাদের সন্তানের দেখভালের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের সাহায্য নেন। সামাজিক মূল্যবোধ ও আধুনিকায়নের কারণে এখন যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। তবে পরিবারের মধ্যে প্রতিটি মানুষের আলাদা গুরুত্ব আছে, তাকে সেভাবেই মূল্য দিতে হবে। একই সঙ্গে পরিবার যাতে ভেঙে না যায় আমাদের সেই চেষ্টা করতে হবে। মা-বাবাদের আমাদের কাছে রাখতে হবে।’ গতকাল ১৫ মে বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালিত হয়। আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের উদ্দেশ্যে সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র‌্যালিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সর্বশেষ খবর