মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

শেষ হলো না নাগরিক ভোগান্তি

মেয়রদের দুই বছর

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও হাসান ইমন

শেষ হলো না নাগরিক ভোগান্তি

তীব্র যানজটে অচল নগরী। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের লাল তালিকায় শীর্ষে রাজধানী ঢাকা। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জনজীবন, ডেঙ্গুর থাবায় ঘটছে প্রাণহানি। বাড়ির নিচের গুদামে কেমিক্যালের আগুনে পুড়ে কয়লা হচ্ছে প্রিয়জন। সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি, ফুটপাথ হকারের দখলে। রাস্তাজুড়ে বিশৃঙ্খল গণপরিবহন। সব মিলিয়ে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে প্রিয় শহর ঢাকা।

এ শহরকে বদলে সচল, আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুই মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও মো. আতিকুল ইসলাম। কিন্তু তাঁদের দেওয়া ইশতেহারের অধিকাংশ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিস্তর পার্থক্য রাজধানীর বর্তমান চিত্রের। এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছর পূর্ণ করলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম।

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যানজট নিরসনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় গত বছর একটি রুটে বাস সার্ভিস চালু করেছি। নতুন করে আরও তিন রুটে চালু হবে। এ ছাড়া শহরের মধ্যে থাকা বাস টার্মিনালগুলো সরিয়ে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বায়ুদূষণে ৮০ শতাংশ দায়ী পরিবহনে ব্যবহৃত তেল। কারণ এ তেলে ক্ষতিকর লেন থাকে, যেগুলো পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতি। ইটের ভাটা ১০ শতাংশ ও কলকারখানা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে ১০ শতাংশ দায়ী। তবে ইটের ভাটা, কলকারখানা ও অবকাঠামো উন্নয়নে একটা সময় বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। আর শব্দদূষণের জন্য অন্যতম দায়ী যানজট। এ যানজট নিরসনে কাজ করছি। এ ছাড়া যেখানে সেখানে গাড়ির হর্ন না বাজাতে নির্দশনা দিয়ে দেব।’ এ ছাড়া জলাবদ্ধতা, মশা নিধন, যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম সরানোর অশ্বাস দিয়েছিন তিনি।

অসহনীয় যানজটে স্থবির রাজধানী। উত্তরা থেকে মহাখালী হয়ে তেজগাঁও, কারওয়ানবাজার, মতিঝিল পুরো এলাকায় গতকাল ছিল তীব্র যানজট। গরমে যানজটে অতিষ্ঠ যাত্রীরা। রাজধানীর প্রায় সব প্রধান সড়কে যানজট দেখা দিচ্ছে। মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী হয়ে তেজগাঁও অফিসে এসেছেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাসে আসার প্রায় পুরো রুটেই যানজট ছিল। প্রতিটি সিগন্যাল পার হতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। যানজটের কারণে অফিসে পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। মাস দুয়েক হলো যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।’ অফিস সময়ে যানজটের বড় কারণ রাস্তায় এলোমেলো বাস চলাচল। এর সঙ্গে নতুন সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল বেড়ে যাওয়া। কেউ কোনো লেন মানে না। ফলে বাড়ছে যানজট ও দুর্ঘটনা। ফ্লাইওভারের মুখে বাস থামিয়ে চলছে যাত্রী ওঠানো-নামানো। মহাখালী ফ্লাইওভারের জাহাঙ্গীর গেট প্রান্তে দেখা যায় বিকাশ পরিবহনের দুটি বাস বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে ফ্লাইওভারের মুখ আটকিয়ে যাত্রী তুলছে। পেছনে সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্লাইওভার ফাঁকা কিন্তু গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলতার কারণে যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটে সকাল ৮টায় শুরু হয়েছে যানজট। অফিসগামী যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে। রাজধানী ঢাকার পানি, বাতাস ও শব্দ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এসব দূষণ কয়েক গুণ ছাড়িয়ে গেছে। মার্চে শব্দ ও বায়ু দূষণে শীর্ষে অবস্থানে ছিল ঢাকা। তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। দূষণের কারণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। নানামুখী দূষণে মানুষের শ্রবণশক্তি ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জি সমস্যা বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্যান্সারের ঝুঁকিও।

সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি : সড়ক খননে নীতিমালা থাকলেও কেউ মানছে না। যখন যে সংস্থার ইচ্ছা হবে সে খুঁড়ছে। এমনও সড়ক রয়েছে- এক সংস্থা কাজ শেষ করেছে, আরেক সংস্থা এসে একই জায়গায় আবার খুঁড়ছে। খোঁড়াখুঁড়ির এ চিত্র রাজধানীজুড়েই। ফলে দুর্ভোগ মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার সব সড়ক, তেজগাঁও লিঙ্ক রোড, মগবাজার, টিটিপাড়াসহ রাজধানীর অনেক স্থানে চলছে দুই সিটির খোঁড়াখুঁড়ি।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রায় ১৫০ কোটি টাকা মশা নিধনে বরাদ্দ করলেও বহাল তবিয়তে আছে মশা। ওষুধ কিংবা ধোঁয়া কোনো কিছুই বাগে আনতে পারছে না মশাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মশা নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বরাদ্দ রেখেছে ১১০ কোটি টাকা। এ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বরাদ্দ রেখেছে ৩৫ দশমিক ৩০ কোটি টাকা। প্রতি বছর মশা নিধন খাতে এ রকম বরাদ্দ থাকলেও উপদ্রব কমছে না মশার। বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরের ভয় আর বাকি সময় ঝাঁকে ঝাঁকে কিউলেক্স মশার কামড়ে ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে প্রাণ। গতকাল ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন আটজন। বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৩ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২১২ জন। রাজধানীর মহানগর প্রজেক্টের বাসিন্দা চারুলতা বিশ্বাস বলেন, ‘বিকাল হতেই বাসার সব জানালা বন্ধ করে দিই। কিন্তু তাতেও নিস্তার মেলে না। মশার কামড়ে ছেলেমেয়েরা পড়তে বসতে পারে না। কয়েল, ব্যাট কিছুতেই যায় না মশা।’ তিনি বলেন, ‘দিনে এডিস মশার ভয়, রাতে কিউলেক্স মশার কামড়!’ শুষ্ক মৌসুমেও কাদাপানিতে ভাসমান ডিএনসিসির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের নূরের চালা, সাঈদনগর এলাকা। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। পুরো এলাকা তলিয়ে যায় কোমরপানিতে। পূর্ব ও মধ্য বাড্ডার সড়কগুলোয় বৃষ্টি হলেই জমে হাঁটুপানি। ড্রেন না থাকায় এ এলাকা জলাবদ্ধ থাকে। এসব সড়ক দিয়ে যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাতে হয় যাতায়াতকারীদের।

রাজধানীর ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার মতো পরিস্থিতি নেই। ফুটপাথজুড়ে হকারের ব্যবসা। কিছু জায়গায় উন্নয়নযজ্ঞে উধাও হয়ে গেছে ফুটপাথ। রাজধানীর ব্যস্ত এলাকার মধ্যে অন্যতম শাহবাগ। এর মধ্যে ওই সড়কে চলছে মেট্রোরেলের কাজ। এজন্য উধাও হয়ে গেছে ফুটওভার ব্রিজ ও ফুটপাথ। নগরবাসীর বিনোদনের জন্য নেই কোনো জায়গা। পার্ক, খেলার মাঠ না থাকায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ। পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসার বলি হচ্ছেন বাসিন্দারা। নিমতলীর পর চকবাজারে অগ্নিকাণ্ড। ঘটনা ঘটলেই আলোচনা, এরপর সব শেষ। ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকা যেন পরিণত হয়েছে কেমিক্যাল নগরীতে। ওই এলাকায় একটি বাড়িও খুঁজে পাওয় যাবে না যেখানে কেমিক্যাল নেই। প্রতিটি বাড়ির নিচ কেমিক্যালে ঠাসা। চকবাজার, নিমতলী, বংশাল, বাবুবাজার, মৌলভীবাজার, লালবাগ, গেন্ডারিয়াসহ পুরান ঢাকার অলিগলিতে এখনো ছোট-বড় হাজারো অবৈধ কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম রয়েছে। আবাসিক এলাকার মধ্যে অবস্থিত এসব কারখানা ও গোডাউনে রয়েছে প্লাস্টিক, কসমেটিকস, সল্যুশন, মেডিসিন ও গাম বানানোর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কেমিক্যাল। অতীতে আগুনের ‘হত্যাযজ্ঞের’ পরও পুরান ঢাকাবাসীর এখনো কেমিক্যালের সঙ্গেই বসবাস।

ব্যাটারিচালিত রিকশা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানীর প্রধান সড়কে যাত্রী পরিবহন করছে। পায়েচালিত রিকশার চেয়ে এর গতি বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার শিকার অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। এতে অনেক পরিবারই নিঃস্ব হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ অপরিকল্পিত নগরীতে দুই বছর কিছুই না। তবে তাঁদের কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ ছিল। কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারের অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। তাঁদের দূরদর্শিতা থাকলে কিছু বাস্তবায়ন করা যেত। যানজট নিরসনে গণপরিবহনের সংখ্যা বা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গণপরিবহন নামানো যেত। এতে গণপরিবহন অনেকটা শৃঙ্খলায় আসত। তবে খাল পরিষ্কার, অবৈধ দখল, বাসরুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রম চালু করায় তাঁদের সাধুবাদ জানাই।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর