রবিবার, ২২ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

যৌতুকের বলি হচ্ছেন নারী

২০২১ সালে ৪৫ জনকে হত্যা, টাকা না পেলেই অমানুষিক নির্যাতন

জিন্নাতুন নূর

যৌতুকের বলি হচ্ছেন নারী

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে রাজমিস্ত্রি রাজন মিয়া তার স্ত্রী শেফালী আক্তারকে (ছদ্মনাম) যৌতুকের কারণে অমানুষিক নির্যাতন করেন। বিয়ের সময় শেফালীর রিকশাচালক বাবা রাজনকে যৌতুক হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দিলেও আবার যৌতুক চেয়ে গত রোজার আগে থেকে শেফালীর ওপর নির্যাতন চালাতে থাকেন রাজন। পরে শেফালীর বাবা মেয়ের সুখের কথা ভেবে যৌতুক হিসেবে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেন। এর পরও নগদ ২০ হাজার টাকা, খাট, শোকেস, আলনা ইত্যাদি যৌতুক হিসেবে চাইলে বাবার কাছে এগুলো চাইতে অস্বীকার করেন শেফালী। এরপর শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। সম্প্রতি শেফালীর স্বামীসহ তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। হাত-পা বেঁধে মারধর শেষে শরীরে মরিচের গুঁড়া ঢেলে তাকে পুকুরে ফেলে দেন। গত মাসের মাঝামাঝি হবিগঞ্জের মাধবপুরে দেড় লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে মৌসুমী আক্তারের গালে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়াসহ অমানুষিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে স্বামী সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এর আগে যৌতুকের টাকা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে মৌসুমীকে মারধর করা হয়। নির্যাতনকালে স্বামীর সঙ্গে শাশুড়ি ও ননদও যোগ দেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যে, ২০২১ সালে কন্যাশিশুসহ যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকারগ্ন ১৩৮ জন। এর মধ্যে ৪৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যৌতুকসহ বিভিন্ন সহিংসতায় স্বামীর নির্যাতনে ৬০ নারীর মৃত্যু হয়। চলতি বছরই লক্ষ্মীপুরে যৌতুক না পেয়ে এক গৃহবধূর মাথা ন্যাড়া করে হাত-পা বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এতে ভুক্তভোগী নারী সদর থানায় মামলা করেন। এ মামলায় নির্যাতিতার স্বামী মো. হাসান, শ্বশুর কাঞ্চন মাঝি, ননদ পাখি বেগম ও তার শাশুড়িকে আসামি করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৩ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে সেই গৃহবধূর স্বামী, শাশুড়ি ও ননদ তার হাত-পা বেঁধে ব্লেড দিয়ে মাথা ন্যাড়া করে নির্যাতন চালান। পরে ঘরে বেঁধে রেখে সবাই পালিয়ে যান। সাম্প্রতিক সময়ে যৌতুকের কারণে প্রায়ই গৃহবধূদের ওপর অমানবিক নির্যাতন ঘটছে। যৌতুকের টাকা একবার আদায় করে আবারও যৌতুক পেতে স্ত্রীর ওপর অর্থলোভী কিছু স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন চাপ দিচ্ছেন। আর যৌতুকের টাকা দিতে রাজি না হলে সেই নারীর ওপর নেমে আসছে ভয়াবহ নির্যাতন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়াও মধ্যযুগীয় কায়দায় ভুক্তভোগীর ওপর হামলা চালাচ্ছে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আবার যৌতুকের লোভে ভুক্তভোগী এবং তার সন্তান ও পরিবারের লোকজনদের ওপরও হামলা চালানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের কয়েক মাস পার হলেই যৌতুকের জন্য বিবাহিত নারীদের ওপর চাপ দেওয়া হলেও বিয়ের সাত-আট বছর পরও অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের কারণে নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। অবস্থা এমন যে এখন পারিবারিক বিয়ে বা প্রেমের বিয়ে যা-ই হোক না কেন ভয়াবহ এই সামাজিক ব্যাধির ছোবলে প্রাণ ঝরছে অনেক গৃহবধূর। সামাজিক এ ব্যাধি বন্ধে দেশে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘৃণ্য এ প্রথা শুধু আইন প্রয়োগে বন্ধ করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। গত এক দশকে যৌতুকের কারণে গৃহবধূর মৃত্যুর ঘটনা এবং আত্মহত্যা করার হার কিছুটা কমে আসতে শুরু করলেও বর্তমান অবস্থাকে সন্তোষজনক বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, করোনা মহামারিতে অনেক দম্পতি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষিত, মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের যে ছেলেরা আগে যৌতুকের জন্য স্ত্রীর ওপর চাপ দেওয়ার কথা ভাবতেন না, তারাও এখন স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে অর্থ এনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আইনজ্ঞরা বলছেন, যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ থাকলেও আইনটির নানা ফাঁকফোকর থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। এ আইনে যৌতুকের সংজ্ঞা নির্ধারণে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর, মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহারসামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হবে না।’ আইনের এ ব্যাখ্যার সুযোগে মূল্যবান অনেক সামগ্রী যৌতুকের নামে এখন দেওয়া-নেওয়া চলছে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়েতে যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদানের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারগুলো যৌতুক ছাড়া মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না। ছোটখাটো স্বর্ণালংকার ছাড়াও বিয়ের সময় কমপক্ষে অর্ধলাখ টাকা দিতে হচ্ছে। আবার শহরে মেয়ের সংসার সাজিয়ে দেওয়ার নামে অভিভাবকদের দামি আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, গাড়ি, মোটরসাইকেলের মতো মূল্যবান সামগ্রী কিনে দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় যৌতুকের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না, যা দুঃখজনক। আবার কিছু ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদের এ মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত মামলাগুলো গতি হারিয়ে ফেলছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর