বুধবার, ১ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বাজেটে আট চ্যালেঞ্জ

বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, ভর্তুকির সংস্থান, ঘাটতি কমানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থিতিশীল রিজার্ভ, ব্যাংক ঋণের সুদহার, রাজস্ব আদায়

মানিক মুনতাসির

বাজেটে আট চ্যালেঞ্জ

আসছে ৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য অর্থ বিভাগ ও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। চলছে শেষ মুহূর্তের ঘষামাজা। করোনা মহামারি পরবর্তী নতুন বিশ্বের সামনে কঠিন এক চ্যালেঞ্জ এনে দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যার প্রভাবে সারা বিশ্বেই জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাংলাদেশে বেড়েছে অসহনীয়ভাবে। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থা। ডলারের বাজার অস্থির হয়ে ওঠায় আমদানি-রপ্তানি খাতেও পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। এমন এক বৈরী সময়ের মধ্যে সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ এসে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করছে।

অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতার খসড়াও কাটাছেঁড়া করছেন। তার এই বাজেট বক্তৃতা আগামী সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রিন্টের জন্য পাঠানো হবে। বাজেটের খসড়ায় অর্থমন্ত্রী সামনের দিনগুলোকে মোকাবিলার জন্য আটটি চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করেছেন, যেগুলো মূলত আসছে বছরের বাজেটেরই প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে নিয়ে দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নয়ন বিশ্বের কাতারে শামিল করাতে চায় সরকার। এরই একটা প্রক্ষেপণ করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বাজেট বক্তৃতায় যেসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন, তা অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে সংসদে তুলে ধরবেন এভাবে- প্রতিবছরের ন্যায় চলতি অর্থবছরও বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে আমি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনসমূহ, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সংলাপ করেছি। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাজেটের ওপর প্রস্তাবনা পেয়েছি। এ জন্য আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। এসব আলোচনা, প্রস্তাব ও আমাদের বিশ্লেষণে  আগামী অর্থবছরের প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ হবে : (১) আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ; (২) তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান; (৩) বেসরকারি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখে কর্মসৃজন; (৪) আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা; (৫) ব্যাংক ঋণের সুদের হার বর্তমান পর্যায়ে রাখা; (৬) রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো ও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা; (৭) কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া এবং (৮) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানো।

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এটা সামান্য কমানো হতে পারে শেষ মুহূর্তে, যার পর্যালোচনা এখনো চলছে। এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে এবারের বাজেটে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বাড়ছে। তবে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ এই প্রথমবারের মতো ৬ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে বলে জানা গেছে। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা পরিস্থিতি বিবেচনায় ঘাটতির প্রাক্কলন বাড়ানোর বিষয়েই ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থমন্ত্রী বাজেটে স্বস্তিদায়ক খবর দিতে চান জনগণকে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। এখনো বাড়ছে। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী, যা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে গ্যাস, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, সার কিংবা পানির দাম বাড়ালে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে, যার একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ফলে মানুষকে নতুন করে কোনো কষ্টের মধ্যে ফেলতে চায় না সরকার। এসব বিবেচনায় আপাতত গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেল, সার কিংবা পানির দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘোষণার পর পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেটের অঙ্ক যা-ই হোক, বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু হলেও সুখবর দিতে চায় সরকার। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। জনগণের কাঁধে নতুন করে করের বোঝা না চাপানো। যদিও বাজেটের ঘাটতি ও ভর্তুকি কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের জ্বালানি ও পরিষেবার দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। কিন্তু আসছে বাজেটে এমন কিছু উদ্যোগ নিতে চায় সরকার, যার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বাড়বে না, জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে থাকবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বাজেট প্রণয়নের কাজ করছেন অর্থ বিভাগে কর্মকর্তারা। আর অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন, এবারের বাজেট হবে জনকল্যাণের বাজেট। এমন একটি বাজেট দেওয়া হবে, যার মাধ্যমে সবাই উপকৃত হবেন। সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার আর দুটি বাজেট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পূর্ণাঙ্গ বাজেট উপস্থাপন এবং বাস্তবায়ন করতে পারবে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট উপস্থাপন করলেও বাস্তবায়নে সময় পাবে অর্ধেক। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ভোটার সন্তুষ্টির দিকটি সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। আর এই ভাবনা মাথায় রেখেই আগামী বাজেটের অর্থ বরাদ্দের খাত সাজানো হচ্ছে। যেসব খাতের সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সরাসরি ভোটার তুষ্টির বিষয় সম্পৃক্ত আগামী বাজেটে সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যেমন বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় বাড়ানোর ঘোষণা আসছে, তেমনি সুবিধাভোগীর আওতাও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। বাজেটের আরও কোন কোন খাতে নজর দিলে ভোটারদের আকৃষ্ট করা যাবে সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া করোনা মহামারির কারণে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেও নতুন রূপরেখা থাকছে আগামী বাজেটে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর