মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

হঠাৎ কেন পোশাকশিল্পে অস্থিরতা

ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা চান শ্রমিকরা, চলতি মাসেই মহার্ঘ্য ভাতা চালু ও মজুরি বোর্ড গঠনের দাবি, দাবি যৌক্তিক বললেও ২০২৪ সালের আগে মজুরি বোর্ড গঠনে আপত্তি মালিকদের

রুহুল আমিন রাসেল

বেতন বাড়ানোর দাবিতে হঠাৎ শ্রমিকদের আন্দোলনে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে পোশাকশিল্পে। শ্রমিকপক্ষের দাবি, দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। চলতি জুনেই মহার্ঘ্য ভাতা চালু করতে হবে। অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে। পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মূল মজুরি ২০ হাজার টাকা ঘোষণা করতে হবে। শ্রমিকদের এ দাবি যৌক্তিক বললেও ২০২৪ সালের আগে নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের পক্ষে নন মালিকরা।

জানা গেছে, পোশাকশিল্প মালিকরা এখন আর বেশি দাম না পেলে বৈশ্বিক ক্রেতাদের অর্ডার বা ক্রয়াদেশ নিচ্ছেন না। কারণ পোশাক খাতে ব্যবসা এখন রমরমা। কারখানাগুলোয় রেকর্ড পরিমাণ ক্রয়াদেশ ও রপ্তানির তথ্য পাওয়া গেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই পুরো অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ায় সার্বিক রপ্তানিতে বড় উল্লম্ফন দেখছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি।

জানা গেছে, পোশাক খাতে ব্যবসা রমরমা হলেও ভালো নেই শ্রমিকরা। কারোনাকালে নিদারুণ কষ্টে আছেন তারা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম। বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এমন পরিস্থিতিতে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে কয়েক দিন যাবৎ রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন পোশাকশ্রমিকরা।

দেশে এখন পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালে পোশাকশ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন হওয়ার কথা রয়েছে। এখন শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলেও বেতন বাড়ানো যাবে না। পোশাক কারখানায় ভাঙচুর কোনোভাবে কাম্য নয়।’

একই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএর কার্যকরী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক। কিন্তু এ দাবি আদায়ের নামে বহিরাগতরা রাজপথে আন্দোলন করতে পারে না। কেউ কোথাও লিখিত দাবিনামা দেয়নি। আসলে পোশাকশ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে রাজপথের আন্দোলনে নামানো হচ্ছে। মূলত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি কিছু সংস্থা কাজ করছে। পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।’

তবে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে জিনিসপত্রের দাম এখন অনেক বেশি। কিন্তু মজুরি তেমন বেশি না। এমন পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আর যদি মালিকরা মনে করেন ২০২৪ সালের আগে মজুরি বোর্ড গঠন করা যাবে না, তাহলে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি, ২০২৪ সালের আগে জিনিসপত্রের দামও বাড়ানো যাবে না।’

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। এখন বেতন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। কিন্তু বেতন বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। তাই শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর আন্দোলন করছেন। আবার অনেক কারখানার শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতেও রাজপথে নেমেছেন। এ অবস্থায় সরকারের কাছে আমাদের দাবি, দ্রুত মজুরি বোর্ড গঠন করে অবহেলিত পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হোক।’ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কার্যকরী সভাপতি কাজী রুহুল আমীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান আন্দোলনে দমন-পীড়ন বন্ধ করে চলতি জুনেই অন্তত ৫০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা চালু এবং অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ২০ হাজার টাকা ন্যূনতম বেসিক মজুরি ঘোষণা করতে হবে।’ এ দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের মাত্রাহীন বৃদ্ধির মুখে দাঁড়িয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের পক্ষে আর কোনোভাবেই জীবন ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা বিভিন্ন শিল্প এলাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা-গ্রেফতার ও নির্যাতন চলছে। আন্দোলন দমনের পথ পরিহার করে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়েই শিল্পে উৎপাদনের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) পরিচালিত ‘করোনায় পোশাকশ্রমিকদের ওপর কী প্রভাব পড়েছে’ শীর্ষক জরিপে পাওয়া তথ্য বলছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর ২০২০ সালের মে ও জুনে পোশাকশ্রমিকরা দিনে আট ঘণ্টা কাজ করতেন। তবে ওই বছর ঈদুল ফিতরের আগে জুলাইয়ে তা বেড়ে ১০ ঘণ্টায় পৌঁছায়। তারপর কয়েক মাস কাজ কম হয়। গত বছরের জুনে আবারও বাড়ে। মাঝে গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর বাদ দিলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করেছেন শ্রমিকরা। তবে গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ ঘণ্টায়। এতে বেতন না বাড়লেও ওভারটাইমের কারণে একেকজন শ্রমিকের মাসিক আয় বেড়ে হয় ১২-১৩ হাজার টাকা।

অবশ্য পোশাকশ্রমিকদের আয় বৃদ্ধির আগেই তাদের বাসা ভাড়া বেড়েছে। ২০২০ সালে একজন শ্রমিকের বাসা ভাড়া ছিল গড়ে ৩ হাজার টাকা। চলতি বছর তা বেড়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা হয়েছে। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে বাসা ভাড়া বেড়েছে ১৭ শতাংশ। আবার চালের দামও বেড়েছে। শ্রমিকরা জানান, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৪৮ টাকা কেজিতে চাল কিনেছেন। গত জানুয়ারিতে সে চাল কিনতে হয়েছে ৫৪ টাকায়। চালের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ।

বেতন বৃদ্ধির দাবি শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ

সর্বশেষ খবর