বুধবার, ৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

কুমিল্লায় এক ডজন ফ্যাক্টর

গোলাম রাব্বানী ও মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা থেকে

কুমিল্লায় এক ডজন ফ্যাক্টর

বিগত ২০১৭ সালের কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে মাত্র ১১ হাজার ৮৫ ভোটে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। এবারে তিনি স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী, দলীয় সমর্থন নেই তারপক্ষে। এ ছাড়া সে¦চ্ছাসেবক দলের সাবেক এক নেতাও এবারে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। যদিও দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় এই দুই প্রার্থীকে বিএনপি বহিষ্কার করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীও পরিবর্তন হয়েছে। দলের ১৪ জন নৌকা প্রতীক চেয়েছিলেন। তবে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন নতুন মুখ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত।

সব মিলে এ সিটির নগর পিতার ভাগ্য নির্ধারণে ব্যক্তি ইমেজ, দল ও প্রতীকের বাইরেও রয়েছে অনেক মারপ্যাঁচ। ভোটের মাঠে যুক্ত হয়েছে নতুন হিসাব-নিকাশ। প্রচারণা ও দলীয় কর্মকান্ডের বাইরে জয়-পরাজয়ে কমপক্ষে এক ডজন ফ্যাক্টর কাজ করবে ভোটের মাঠে। এসব ফ্যাক্টরকে নিজের দিকে আনতে নিজ নিজ শক্তি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন মেয়র প্রার্থীরা।

এবারের কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচজন প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে আলোচনায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ও বিএনপির সাবেক নেতা কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ও সে¦চ্ছাসবক দলের সাবেক নেতা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করেন ভোটাররা। আগামী ১৫ জুন এ সিটিতে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হবে। এ সিটি নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শেষ হবে ১৩ জুন মধ্যরাতে। সেই হিসাবে আরও ছয় দিন ভোটের প্রচারণার সুযোগ পাবেন প্রার্থীরা।

কুমিল্লার বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণী ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে- নারী ভোটার; তরুণ ভোট; সংখ্যালঘু ভোটার; সদর দক্ষিণের ভোটার; অঞ্চল ভিত্তিক ভোট তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়া   চাঁদপুরের ভোট; জামায়াত-কওমি সমর্থিত ভোট; বস্তি-কলোনির ভোট; সরকারি বিরোধী মনোভাব; আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল; বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল-বিদ্রোহী গ্রুপের ভোট; নগরের জলাবদ্ধতা ও যানজট; উন্নয়ন বঞ্চিত এলাকার ভোট এবং কিছু ওয়ার্ডে বাড়ি-ঘর নির্মাণে চাঁদাবাজি হওয়ায় বিক্ষুব্ধ রয়েছেন অনেক ভোটার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোটের আগ মুহূর্তে এই হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে পুরো চিত্র।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলেছেন, নির্বাচনী মাঠে প্রধান দুই মেয়র প্রার্থীর জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আওয়ামী লীগের সবাই এখনো মাঠে নামেনি। রিফাতের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা থাকলেও মেয়র পদে মনোনয়ন চাওয়া অপর ১৩ নেতা ও তাদের অনুসারীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রয়েছে আওয়ামী লীগের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী। তারাও নিজেদের ভোট নিয়ে ব্যস্ত। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা অধ্যক্ষ আফজল খানের পরিবারের রয়েছে ভোট ব্যাংক। কিন্তু তারাও প্রকাশ্যে মাঠে নেই। এ ছাড়া আরও আওয়ামী লীগের দু-তিনটি ভোট পকেট রিফাতের পক্ষে নেই। দলীয় কোন্দলের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত বলেন, সীমা আমার দলের নারী এমপি। সীমা সাক্কুর পক্ষে কাজ করবে এটা আমি চিন্তা করি না। ২৭ ওয়ার্ডে কমিটি গঠন হয়েছে। সবাই কাজ করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, টানা দুই দফায় মেয়র থাকা মনিরুলের বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। উন্নয়নকাজ নিম্নমানের, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নিজের সম্পদ বৃদ্ধিসহ আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে সাক্কুর বিরুদ্ধে। তাই নগরবাসী এবারে ভোট দিতে সেই সব বিষয়ও হিসাব-নিকাশ করবেন। এ ছাড়া সাক্কুর গলার কাঁটা হিসেবে রয়েছেন সে¦চ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতা কায়সার। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় এবারে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত ভোট দুই ভাগে ভাগ হচ্ছে। পাশাপাশি নগরের জলাবদ্ধতা ও যানজট এবং উন্নয়ন বঞ্চিত হওয়ায় অনেকেই সাবেক মেয়রের ওপরে ক্ষুব্ধ। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নগরীর দক্ষিণ অংশে রয়েছে প্রায় ৬৫ হাজারের মতো ভোটার। এ এলাকায় কাজ কম হওয়ায় ক্ষুব্ধ ভোটাররা। এ ছাড়া সদর দক্ষিণের বাসিন্দা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মনোনয়ন বিষয়ে কথা বলায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে সম্প্রতি। এই প্রভাবও ভোটের মাঠে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, কুমিল্লার যে কোনো নির্বাচনে নারী ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর। কারণ এই সিটিতে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি। বিগত নির্বাচনে মেয়র পদে একজন নারী প্রার্থী থাকায় নারী ভোটারের বেশি সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। তারপরেও এবারে নারীদের ভোট বড় ফ্যাক্টর। সিটির একজন ভোটার বলেন, আমি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। দেশে ফিরে সিটি এলাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করতে আওয়ামী লীগের নির্ধারিত ব্যক্তির কাছ থেকে রড-ইট-বালি-সিমেন্ট কিনতে বলা হয় এবং মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে। পরে আমার এক পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে আমি তাদের নির্ধারিত ব্যক্তির কাছ থেকে শুধু বালি-সিমেন্ট নেই। শহরে বাড়ি করতে হলে অনেককেই চাঁদা দিতে হয়। এখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাবেক মেয়রের লোকজনও জড়িত।

সিটির ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি হচ্ছে। সেখানে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির লোকজন জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সেই বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে কেন হয় সেটা আপনরা যাচাই করেন। আমরা চেষ্টা করি যেন এমন না হয়। কিন্তু তারা এত প্রভাবশালী যে আমি অনেককে পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করতে বলেছি। কিন্তু ভয়ে কেউ অভিযোগ করেন না। বিএনপির লোকজন সঙ্গে আছে কি না প্রশ্নে বিএনপির সাবেক এই নেতা বলেন, যারা ভালো মনে করছেন তারা আমার পক্ষে কাজ করছেন। যারা মনে করছেন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যামু না তারা থাকছেন না। এ ভাবেই চলছে। ইসি জানিয়েছে, বিগত ২০১৭ সালের কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ভোটার ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ জন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন ও পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুজন। সেই হিসাবে গত নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোটার বেড়েছে ২২ হাজার ৩৫৪ জন; যাদের প্রায় সবাই তরুণ। এ ছাড়া এখানে পুরুষ থেকে নারী ভোটার বেশি। আর সংখ্যালঘু ভোটারও প্রায় ৩৫ হাজার। তাই যে মেয়র প্রার্থী সিটির নারী, তরুণ ও সংখ্যালঘু ভোট নিজের দিকে টানতে পারবেন তিনিই হাসবেন শেষ হাসি। প্রচারে মেয়র প্রার্থীরা : নগরীর মুরাদপুর চৌমুহনীতে পথসভা করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচির বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে তিনি মিটিং করতে পারেন। এতে অন্যায়ের কিছু আমি দেখি না। তিনি (রিফাত) জনগণের কাছে যান না, সাক্কুর এমন একটি কথা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রিফাত বলেন, আমি যদি মানুষের কাছে না যাই, এরা কারা? তখন নৌকার পক্ষে উপস্থিত কর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন।

গতকাল কুমিল্লা আদালতে আইনজীবী সমিতির সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। এ সময় তিনি বলেন, কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করছেন। তিনি আইনজীবী সমিতির সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি শুনছি নৌকা প্রতীক আনতে ৬০ কোটি টাকা ঘুষ দিছে। আমি তো এই কথা বিশ্বাস করি না। দল যারে ভালো মনে করছে তারে নমিনেশন দিয়েছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার নগরীর নওগাঁ চৌমুহনী এলাকা থেকে গণসংযোগ শুরু করেন। দৈয়ারা এলাকায় তিনি বলেন, কমিশনকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা না নিলে ধরে নেব এটিও একটি ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই নেতা বহিষ্কার : কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে জামায়াত-শিবির সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় ১ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আবু মোহাম্মদ নৌশাদকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এদিকে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মোশারফ হোসেনকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন মোর্শেদও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়।

আজ প্রচারে নামবে জেলা আওয়ামী লীগ : কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে আজ মাঠে নামবে জেলা আওয়ামী লীগ। জেলা কমিটির নেতা-কর্মীরা আরফানুলের পক্ষে আজ বুধবার থেকে গণসংযোগে নামবেন বলে জানা গেছে। সোমবার রাতে নগরের রামঘাট দলীয় কার্যালয়ে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর