বুধবার, ৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

একজন বাউল দাদার স্বদেশ ফেরা

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

একজন বাউল দাদার স্বদেশ ফেরা

দীর্ঘকাল পর যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে গেলেন সানোয়ার আহমেদ। জীবনের শেষ দিনগুলো পরিবারের সঙ্গে কাটাবেন। তাই ২ জুন সকালে এমিরেটসের ফ্লাইটে তাঁর স্বদেশযাত্রা। নিউইয়র্কে জ্যাকসন  হাইটসের ৭৩ স্ট্রিটে ‘নবান্ন’ রেস্তোরাঁর সামনে রাস্তার ধারে ঝালমুড়ি আর পান বিক্রি করে সবার নজর কাড়েন সানোয়ার আহমেদ। কালক্রমে তিনি প্রবাসীদের কাছে হয়ে ওঠেন প্রিয় ‘বাউল দাদা’। রোদ-বৃষ্টি-শীত-বরফ উপেক্ষা করে বছরের পর বছর এখানে সরবে অবস্থান করেন তিনি। প্রবাসে তিন-চার ফুট পরিসরের এ খোলা জায়গাটি যেন ছিল বাউল দাদার আপন ভুবন। তবে সব সময় নিরাপদ-নিশ্চিন্তে থাকতে পারেননি। মাঝেমধ্যেই পোহাতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। কখনোকখনো তাঁর ওপর নেমে আসে প্রশাসনের খড়্গ। কোনো কোনো স্বদেশি বনে যায় তাঁর প্রতিপক্ষ। ফুটপাথ থেকে বারবার উচ্ছেদ হয়েছেন। দোকানদারির সরঞ্জাম কেড়ে নিয়ে যান প্রশাসনের লোকজন। তবে কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের সহায়তায় সরঞ্জামগুলো আবার ফিরেও পান। অনেক ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও ৭৩ স্ট্রিটের ওই জায়গাটুকু আঁকড়ে থাকেন বাউল দাদা। কিন্তু করোনা মহামারির থাবায় এ ব্যবসায় আর টিকে থাকা হলো না। দেশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অবসরে ছিলেন তিনি। ৪১ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসে রেস্তোরাঁয় থালাবাসন সাফ করা আর রান্নাবান্নার কাজ শুরু করেছিলেন। অনেকদিন করেছেন এ কাজ। বুড়ো বয়সে কেউ কাজ দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, প্রচ- গরম ও ঠান্ডার মধ্যেও সপ্তাহে সাত দিন ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি ও পান বিক্রি করে গেছেন। স্বদেশযাত্রার আগে বাউল দাদা বলেন, ‘দীর্ঘ একাকী প্রবাসজীবন শেষে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরছি। যৌবনে উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকায় এসেছিলাম। তখন কাজকর্মেরও সুযোগ ছিল। পেয়েছিলাম ওয়ার্ক পারমিট।’ বাউল দাদা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। সফল হননি। আইনি জটিলতায় পড়ে শেষ জীবনে ওয়ার্ক পারমিটও হারিয়েছেন। যে সোনার হরিণের আশায় এসেছিলেন তার নাগাল না পেয়ে তাঁকে অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে। গ্রিনকার্ড নামক যে সোনার হরিণ আয়ত্তের আশায় স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে এলেন, সেই হরিণ অধরাই থেকে গেল। আমেরিকায় বেওয়ারিশ দশায় মরতে চান না বাউল দাদা। তাঁর দেশে ফেরার বিষয়ে সাহায্য করেছে নিউইয়র্ক অঞ্চলে অভিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে লড়াইরত ‘দেশিজ রাইজিং আপ অ্যান্ড মুভিং-ড্রাম’। বাউল দাদার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার দক্ষিণ বালিগ্রামে। বিয়ে করেন ১৯৭১ সালে। দালাল ধরে ভ্রমণ ভিসায় আমেরিকায় এসেছিলেন। তখন দালালকে দিতে হয়েছিল ৩ লাখ টাকা। দেশে রেখে এসেছিলেন স্ত্রী ছায়া বেগম, দুই মেয়ে ছানারা বেগম, রায়না বেগম, ছেলে ছোবান মিয়া, পারভেজ মিয়া ও মজনু মিয়া। এদের মধ্যে মজনু মিয়া নিখোঁজ। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মেয়েটির স্বামী মারা যান। তখন তিনি অনুমতি নিয়ে দেশে গিয়েছিলেন। ৪২ বছরে সেই একবারই স্ত্রী-সন্তানদের দেখার সুযোগ হয়েছিল। দেশে সাড়ে চার মাস থাকার পর ফের চলে আসেন আমেরিকায়। পরে ছোট মেয়ের স্বামীও মারা যান। অসহায় মানুষের জন্য নিবেদিতদের একজন ড্রাম-এর সংগঠক কাজী ফৌজিয়া তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘জেএফকে এয়ারপোর্টে চোখের পানি আড়াল করে যখন বিদায় দিচ্ছিলাম, বাউল দাদা হঠাৎ তাঁর পকেট থেকে টাকা বের করে আমায় বলেন “কিছু খেয়ে নিও”। এমনই ছিলেন আমাদের বাউল দাদা। সবাই বাউল দাদার জন্য দোয়া করবেন।’ অভিবাসন ইস্যুতে ডেমোক্র্যাটদের ভন্ডামির অসহায় ভিকটিম হয়ে আপন ভুবনে ফিরতে বাধ্য হলেন বাউল দাদা। তাঁর ব্যবহৃত খাট আর বিছানাপত্র সংরক্ষণ করেছে ব্রুকলিনের একটি জাদুঘর।

বাউল দাদার হালহকিকতের আলোকে অভিবাসীদের নিদারুণ কষ্টের একটি প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন ব্রিটেনের এক চলচ্চিত্রকার।

সর্বশেষ খবর