শুক্রবার, ১০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

অতিমারির পর অতি সতর্ক বাজেট

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মূল কৌশল চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমানো

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

অতিমারির পর অতি সতর্ক বাজেট

টানা দুই বছর ধরে করোনা মহামারির অভিঘাত অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে, সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্য নতুন বাজেটে দরকার ছিল বাড়তি উদ্যম, বাড়তি প্রেরণা। থেমে যাওয়া শিল্পের চাকায় বাড়তি গতির জন্য দরকার ছিল বাড়তি জ্বালানি। গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তাতে সেই বাড়তি উদ্যম, বাড়তি প্রেরণা কিংবা বাড়তি জ্বালানি তেমনভাবে চোখে পড়েনি। এর বদলে যেটি দেখা গেছে- তার নাম সতর্কতা। অতিমারির পর অর্থমন্ত্রী নিজের চতুর্থ বাজেটটিকে সে কারণে ‘অতি সতর্ক’ বাজেট হিসেবে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সতর্কতার নমুনা : (১) মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প খাতে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যক্রম এই বছরই শেষ করা; (২) সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণ কমিয়ে ব্যাংক থেকে অত্যধিক মাত্রায় ঋণের টার্গেট নির্ধারণ এবং (৩) মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চাহিদা কমানোকেই মূল কৌশল বিবেচনা করা।

অর্থমন্ত্রী যখন এই বাজেট উপস্থাপন করছিলেন, তার তিন মাস আগে থেকেই ইউরোপে এক ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়েছে, অন্যান্য দেশের মতো যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ব্যাপকভাবে বেড়েছে জ্বালানি, সারসহ খাদ্যপণ্যের দাম। এর মধ্যে জ্বালানি ও সারে ভর্তুকি বাড়িয়ে সরকার উৎপাদনসংশ্লিষ্ট এসব পণ্যের প্রভাব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও খাদ্যপণ্যের দাম দেশের নিম্ন আয়ের মানুষকে ভয়াবহ সংকটে ফেলে দিয়েছে। সে কারণে এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। বাজেট ঘোষণায় সে বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি চলছে এটা সরবরাহজনিত মূল্যস্ফীতি। বিশ্বব্যাপী চাল, গম, জ্বালানি, সারের দাম বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে ম্যাক্রো ইকোনমিক্স সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা বলবেন যে, এখানে চাহিদা কমালে দাম কমবে না। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে হয়তো বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি কিছুটা কমানো যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির যে চাপ সেটি কমবে না। ফলে ভবিষ্যতে, মূল্যস্ফীতি কমানোর চেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ানোর ওপর সরকারের বেশি জোর দেওয়া উচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের শিল্প খাত সচল রাখতে করোনা মহামারির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি খাতে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ২৮টি আর্থিক ও প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত এসব প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে শিল্প খাত উজ্জীবিত হতে শুরু করেছে। আগামী অর্থবছরেও এসব প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে বলে বাজেটে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে সেই সঙ্গে তিনি এটিও বলেছেন, আগামী অর্থবছরই হবে আমাদের অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য শেষ বছর। সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যক্রম যে আগামী বাজেটের মধ্য দিয়েই সমাপ্ত করা হবে এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মূলত সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির পর এখন যুদ্ধকালীন যে সংকট দেখা দিয়েছে তাতে শিল্প-বিনিয়োগে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারের প্রণোদনামূলক কর্মসূচির আরও সম্প্রসারণ দরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঘোষিত বাজেটে ঘাটতি সামাল দিতে যে অর্থায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে- সেখানেও অর্থমন্ত্রীকে ‘অতি সতর্ক’ দেখা গেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মোকাবিলায় ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থায়ন ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ বাড়বে প্রায় ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘাটতি মেটাতে সরকারের ঋণ গ্রহণের দুটি উৎসের মধ্যে বৈদেশিক খাত থেকে এবার ঋণের হার কমানো হয়েছে। কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমায় সরকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে কিছুটা সতর্ক থাকতে চাইছেন। উপরন্তু বাজেট সহায়তা হিসেবে স্বল্পমেয়াদি এসব ঋণ অনেক শর্তযুক্ত। বাকি অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সরকারের ঋণ গ্রহণের আরেকটি বড় খাত হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। কিন্তু মূল্যস্ফীতিজনিত চিন্তা থেকে অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে নতুন বাজেটে এই খাত থেকেও ঋণের টার্গেট কমানো হয়েছে। ফলে ব্যাংক খাত থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণের যে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে- সেটি বাস্তবায়ন করলে বেসরকারি খাতের অর্থায়ন বাধাগ্রস্ত করবে। ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, সরকার বাজেটে কর্মসৃজনে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আবার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। আমাদের দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে মূলত ব্যাংক ঋণ নির্ভরশীল। কারণ পুঁজিবাজার তো মূলধন সংগ্রহে তেমন ভূমিকা পালন করছে না। ফলে এই পরিপ্রেক্ষিতে ঘাটতি অর্থায়নের পরিকল্পনাটি পরস্পর সংগতিপূর্ণ না।

করোনাভাইরাসের কারণে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া প্রায় ১ কোটি ৩৯ লাখ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ এখন সরকারের সামনে। চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের দুর্ভোগ কমানো। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কভিড-১৯-এর প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়া শিল্পের চাকার গতি বাড়ানো। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যেখানে সম্প্রসারণমূলক শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেটের প্রয়োজন সেখানে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় এই ‘চাহিদা কমানোর নীতি’ শিল্পকে কতটা এগিয়ে দেবে- সেটিই বড় প্রশ্ন।

সর্বশেষ খবর