শনিবার, ১১ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃষিতে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক

ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সার-বীজের দাম বেশি, শ্রমিক সংকট

জিন্নাতুন নূর

কৃষিতে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাদারপুরের কৃষক শহীদুল ইসলাম। সাত বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করতেন। এখন এক বিঘাতেও নিজে আবাদ করেন না। অন্যকে বর্গা দিয়েছেন। বছর গেলে তার কাছ থেকে নিজের বর্গা মূল্য বুঝে নেন।

পবা উপজেলার বড়গাছী গ্রামের কৃষক তরিকুল ইসলাম ১৭ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ফসলের চাষ করতেন। এখন চাষের জমি কমিয়েছেন। ছয় বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেন। ১১ বিঘা জমিতে খনন করেছেন পুকুর।

ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সার-বীজ-কীটনাশকের দাম বেশি, ফসল ঘরে তোলার সময় শ্রমিক সংকটের কারণে দিন দিন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে তৃণমূলের কৃষক। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে জেলায় মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। আবাদযোগ্য জমি আছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। গত ৯ বছরে নতুন ৫ হাজার পুকুর খনন করা হয়েছে। ফলে ফসলি জমি কমেছে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর। কৃষিকাজে আগ্রহ হারিয়ে কৃষকরা এখন ঝুঁকছেন মাছ চাষ ও আমবাগানের দিকে।

রাজশাহীর মতো দেশের অন্যান্য এলাকারও একই দশা। কৃষকরা কৃষি পেশা থেকে ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আয়ের বিকল্প পথ তৈরি হওয়ায় এখন আর কৃষিকাজ করে তাদের সংসার চলছে না। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বলছে, দেশের ৬৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ কৃষক নানা সময় অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে ৮৩ দশমিক ১৫ শতাংশ বলে, তাদের খামারের আয় পারিবারিক চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক, অ্যাকশন এইড, কেন্দ্রীয় কৃষক মৈত্রী আয়োজিত পারিবারিক কৃষিতে অর্থায়ন শীর্ষক সেমিনারে এই তথ্য জানানো হয়। দেশের ১১টি অঞ্চলের ১৪টি উপজেলার ৮৬টি গ্রামের ৮৯৯ জন কৃষকের কাছ থেকে এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় জানা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৮১ শতাংশ কৃষক নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে তারা বাজারে অভিগম্যতা এবং বাজারজাতকরণ সহজ মনে করেন না। পারিবারিক কৃষি জোরদার করতে কৃষিজমি সুরক্ষা ও কৃষিজমিতে কৃষকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, কৃষি প্রতিবেশভিত্তিক কৃষি সুরক্ষা, কৃষিতে যুবসমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থে শস্যবিমা, কৃষকদের জন্য পেনশন স্কিম, বীজবিমা এবং অণুজীব ভর্তুকি প্রদানের সুপারিশ করা হয় এই গবেষণা জরিপে। দেশের কয়েকটি এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। মুনাফা না হওয়া, বিনিয়োগে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা, হিমাগারের অভাব, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনবার্সন না করা, শস্যবিমার ব্যবস্থা না থাকা, ঋণ পাওয়ার জটিলতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া নদীভাঙন, খরা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও অনেকে কৃষি পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশই কৃষিকাজের চেয়ে অকৃষিকাজে নিয়োজিত হতে আগ্রহী। ফলে কৃষিকাজে নিয়োজিত কৃষক ও শ্রমিক কমে যাচ্ছে। এদের বড় একটি অংশ আবার কৃষিজমি বিক্রি করে ঋণ নিয়ে বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে নসিমন, করিমন, ভটভটি, টেম্পো, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোয় যুবকদের অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ফলে যুবকদের অনেকেই এখন আর কৃষিকাজে আগ্রহী নয়। এ ছাড়াও কৃষিকাজের বদলে শহরে গার্মেন্টের কাজেই এখন যুবকরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি। তরুণরা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দোকান, শপিং মলে কাজ করছেন। অনেকেই  ছোটখাটো ব্যবসার কাজে জড়াচ্ছেন। নির্মাণকাজ, সেবাখাত, হোটেল-রেস্টুরেন্টেও অনেকে কাজ করছেন। এ ছাড়াও কৃষিতে মুনাফা কম হওয়ায় কৃষি পেশা এর গুরুত্ব হারাচ্ছে। কৃষিখাতের বিনিয়োগে আছে অনিশ্চয়তা। এই পেশায় সন্তানদের আনতে কৃষক বাবারাও উৎসাহী নন। এক সময় দেশে ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজে জড়িত থাকলেও তা এখন কমে এসেছে। মূলত নতুন প্রজন্ম ও কৃষকগোষ্ঠী মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় এই সংখ্যা কমেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ। আর সারা দেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫২ লাখ। জয়ীতা পুরস্কার পাওয়া পবা উপজেলার নারী কৃষক রহিমা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এখন মাঠে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও মজুরি বেশি। চাষাবাদ করে ঘরে ফসল তুলতে গিয়ে কোনো লাভই থাকে না। এ অঞ্চলের কৃষক দিন দিন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অনেকে আগে বিঘার পর বিঘা ধান, সবজি চাষ করেছেন। এখন সেগুলো বর্গা দিয়ে দিচ্ছেন। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, জেলায় গত কয়েক বছরে পুকুর খননের কারণে অনেক ধানি জমি কমেছে। ফসলি জমি নষ্ট করে যাতে পুকুর খনন না করা হয়, সেজন্য তারা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিসটিক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জুলফিকার আহমেদ রেজা বলেন, শ্রমিক সংকটের কারণে এখন কৃষিকাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ হারাচ্ছে। গ্রামে কৃষিকাজ করানোর লোক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেকের জমি থাকলেও শ্রমিক সংকটের কারণে মানুষ ফসল আবাদ করতে পারছে না। এতে নিজেদের জমি তারা অন্যদের কাছে লিজ দিয়ে সেই টাকা দিয়ে বাজার থেকে ফসল কিনে খাচ্ছেন। আবার শ্রমিক দিয়ে কাজ করালে খরচ বেশি পড়ে যাওয়াতে অনেকে ফসল ফলাতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এই অবস্থায় কৃষিকাজে জড়িত শ্রমিকদের খরচ বৃদ্ধি করতে হবে। একইসঙ্গে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক কাজী শাহেদ)

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর