শনিবার, ১১ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

উত্তর মিলছে না অনেক প্রশ্নের

কী হবে ১৯ অজ্ঞাত লাশের

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ এবং ভয়াবহ আগুনের বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তরই মিলছে না। এ দুর্ঘটনায় ৪৬ জন মারা যান। এর মধ্যে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ১৯ জনের মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এদিকে রাসায়নিক বিস্ফোরণের ফলে আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি খতিয়ে দেখতে ঘটনাস্থল বিএম ডিপো থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছে বিশেষজ্ঞ দল।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগুনের উৎস, দায়িত্বে অবহেলা, তথ্য গোপন, রাসায়নিকের বিষয়ে প্রকাশ না করাসহ অনেক প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত অজানা। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঘটনাস্থল চষে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। বিভিন্ন সংস্থার গঠিত তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগুনের উৎস এখনো অজানা। ডিপো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি। অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের সময় কারা কর্মরত ছিলেন, তাও জানাতে পারছেন না। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রতি-উত্তরে তারা জানিয়েছেন, আগুনে পুড়ে গেছে ডিউটি রোস্টার। তাই তাদের কাছে বেতন শিট চাওয়া হয়েছে।’

জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত, বিস্ফোরণের কারণ, ডিপোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল কি না- এসব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় কার কার গাফিলতি রয়েছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য এবং সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে তদন্ত দল। দুর্ঘটনার উৎস, ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণসহ অন্যান্য কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, আগুন এবং বিস্ফোরণের পর সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে এলেও খোঁজ ছিল না ডিপো মালিক কর্তৃপক্ষের। ঘটনার দুই দিন পর ডিপোতে আসেন মালিক কর্তৃপক্ষের লোকজন। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতে ডিপোতে রাসায়নিক থাকার তথ্য জানানো হয়নি ফায়ার সার্ভিসকে। রাসায়নিকের তথ্য শুরুতে দেওয়া হলে জানমালের ক্ষতি অনেক কম হতো। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজও পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ রাখার অনুমতি ছিল না। পরিবেশ অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর, কাস্টমসহ প্রত্যেক সংস্থার অগোচরেই তারা কাজটি দীর্ঘদিন করে আসছিল।’ এদিকে ৪৬ জনের মধ্যে ১৯ মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। তা ছাড়া নিখোঁজ আছেন চারজন। অজ্ঞাত-নিখোঁজ মোট ২৩ জনের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তাদের পরিবারের ৪১ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবের টিম। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচয় শনাক্তের পর মৃতদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। বর্তমানে ১৯ মৃতদেহের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে ১৫টি, চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতালে দুটি এবং চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আছে দুটি।   জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘মৃতদেহ দেখে চেনা যাচ্ছে না, এমন অজ্ঞাত ১৯টি মৃতদেহ ফ্রিজে সংরক্ষিত আছে। অজ্ঞাতদের শনাক্তে তাদের পরিবারের ৪১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর তাদের হস্তান্তর করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘ফ্রিজে রাখা মৃতদেহগুলো যথাযথ যত্নসহকারে সংরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখভাল করছে।’

বিএম ডিপোতে বিশেষজ্ঞ দল : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনায় আশপাশের মানুষের মধ্যে কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ভবিষ্যতে কেমন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে- এমন জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল এসেছে। গতকাল সকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলামের নেতৃত্বে টিমটি ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে। পর্যবেক্ষণের সময় তারা ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চপর্যায়ের টিমের মধ্যে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম, রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-পরিচালক ডা. মো. সফিকুল ইসলাম, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কভিড-১৯ হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সহকারী পরিচালক ডা. অনিন্দিতা শবনম কোরেশী, সহকারী পরিচালক ডা. মাহী উদ্দিন আহমেদ, ইভালুয়েটর ডা. ফাবলিনা নওশিন, ডাটা ম্যানেজার মো. রাকিবুল ইসলাম, বিসিআইসির ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি অ্যান্ড হেলথ বিভাগের কেমিস্ট মো. জিয়াউল হক ও ডেপুটি চিফ মো. হুমায়ুন কবীর। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘রাসায়নিক বিস্ফোরণে কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি উচ্চপর্যায়ের টিম সীতাকুণ্ডের ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে এসেছে। এ টিম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়া রোগীরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কীভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাও পদির্শন করেছেন।’ এদিকে কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আনসার ভিডিপি একাডেমির ইয়াদ আলী প্যারেড গ্রাউন্ডে ২২তম ব্যাচের নবীন ব্যাটালিয়ন আনসারদের ছয় মাসের মৌলিক প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির ঘটনায় দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রশিক্ষণসহ তাদের আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশপ্রেম ও প্রশিক্ষণের জন্যই তারা অন্যদের বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন শনিবার রাত ৯টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকার বিএম কনটেইনারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪৬ জন নিহত এবং ৩ শতাধিক মানুষ আহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৯ মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। গত সোমবার ডিএনএ টেস্টের জন্য অজ্ঞাতদের স্বজনদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৫৫ জন। বর্তমানে ভর্তি আছেন ৫২ জন। এর মধ্যে চক্ষু বিভাগে ৮ জন, সার্জারি বিভাগের দুই ইউনিটে আছে ৮ জন, অর্থোপেডিক বিভাগে ৭ জন, নিউরো সার্জারি বিভাগে ২ জন, ইউরোলজি বিভাগে একজন এবং বার্ন ইউনিটে ২৫ জন ভর্তি আছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন ৭৫ জন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে ১৬ জনকে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর