শনিবার, ১৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

জয় বাংলায় ভাস্কর রাশার নান্দনিকতা

মোস্তফা মতিহার

জয় বাংলায় ভাস্কর রাশার নান্দনিকতা

শিল্পীর মনের ভাষার কোনো শব্দ নেই। নান্দনিকতায়ই লুকিয়ে থাকে হাজারো শব্দ। রংতুলিতে ফুটে ওঠে জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা গল্প। থাকে মানুষের কথা, স্বপ্নের কথা, কল্পনার কথা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতি। হৃদয়ের লালিত স্বপ্নগুলো রংতুলির ছোঁয়ায় অনন্য করে ভাস্কর রাশা তুলে এনেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নানা গল্প। রংতুলিতে বুনেছেন মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্পিত চিত্র। এমন সব শিল্পকর্ম নিয়ে ভাস্কর রাশা সাজিয়েছেন তার শিল্পের পসরা।

গত মঙ্গলবার  শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় শুরু হয়েছে ‘জয় বাংলা’ শিরোনামের সাত দিনের এ প্রদর্শনী। ২৯টি চিত্রকর্ম ও আটটি ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো এ প্রদর্শনীতে প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্যালারিতে কথা হয় দেশের খ্যাতিমান ভাস্কর ও সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী ভাস্কর রাশার সঙ্গে। তিনি বলেন, কোনো শব্দ ছাড়া শুধু রংতুলির মাধ্যমে জীবনের কথা ও মানুষের কথা বলা অনেক কঠিন কাজ। তারপরও এ কঠিন কাজটি খুবই সাবলীলভাবে করার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনা নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’, করোনা নিয়ে ‘প্রতিরোধের জলছাপ’, মাতৃভাষা নিয়ে ‘মাতৃভাষা সংগ্রাম’, বন রক্ষা নিয়ে ‘বন রক্ষার সমাবেশ’, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক নানা ঘটনা নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক বিষয়’, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্পিত চিত্র’ ইত্যাদি সিরিজ শিল্পকর্মের মাধ্যমে শিল্পী তাঁর সৃজনশীলতার নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সিরিজগুলোতে রয়েছে মু্িক্তযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সৈন্যের যুদ্ধের দৃশ্য, রয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতের সময় এদেশীয় রাজাকারদের উল্লাসের চিত্র ও অসহায় নারীর আর্তনাদ। প্রতিরোধের জলছাপে রয়েছে করোনাকে প্রতিরোধ করে টিকে থাকার লড়াইয়ের সংগ্রাম। এ ছাড়া মাতৃভাষার সংগ্রাম সিরিজে রয়েছে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের তৈরি দেশের প্রথম শহীদ মিনারের চিত্র, আমতলায় সমাবেশ ও ঢাকা মেডিকেলের সামনের বিক্ষোভের চিত্র। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্পিত চিত্র সিরিজে তিনি মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণের প্রতিচ্ছবি ও বিশ্বের নানা বৈষম্য প্রতীকিভাবে তুলে ধরেছেন। এ সিরিজটি নিয়ে তিনি বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ একত্রে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র একে অপরের প্রতিপক্ষ থাকবে। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে, মানুষ মারা যাবে, এরপরও নতুনভাবে মানুষ স্বপ্নের বীজ বুনবে আর ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে ধ্বংসস্তূপ থেকে। আর আন্তর্জাতিক পর্বে তিনি জর্জ ফ্লয়েড, প্যালেস্টাইনের শহীদ শিশু ও আইলান কুর্দিকেও শিল্পকর্মে তুলে এনেছেন। ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে ৭ মার্চকে নিয়ে ‘স্বাধীনতার ডাক’, ‘সাত বীরশ্রেষ্ঠ’ ‘হিরোশিমা’ ‘এটম বোমা’ ‘জয় বাংলা’ ‘শিল্পী শাহাবুদ্দিনসহ নানা ভাস্কর্য।

‘হিরোশিমা’ ভাস্কর্যটি নিয়ে শিল্পী বলেন, ৩০০ ফুট উঁচু একটি বড় হিরোশিমা ভাস্কর্য করার বিষয়ে আমর স্বপ্ন রয়েছে। বড় একটি চর লাগবে। এতে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা খরচ হবে। আর বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৫-৩০ জন ভাস্কর এতে কাজ করবেন। ক্রেনসহ অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগবে ৩০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট স্বপ্নের হিরোশিমা ভাস্কর্যটি তৈরিতে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে বলেও প্রত্যাশা করছি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশবরেণ্য ভাস্কর রাশা বলেন, সংস্কৃতিকর্মী ও এ অঙ্গনের মানুষের স্বার্থবিরোধী এরশাদ সরকারের আপত্তিকর কালচারাল কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ তিনটি ভাস্কর্য ও একটিস পেইন্টিং আগুনে পুড়িয়ে ১৯৮৭ সালের ৩০ জুন আমি প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। যার কারণে এরশাদ সরকার তার কালচারাল কমিশন বাতিল করতে বাধ্য হয়। শিল্প ও শিল্পীদের জন্য আমার এ প্রতিবাদটি ওই সময়ে অনেকের প্রশংসায় ভাসছিল। সরেজমিন দেখা গেছে, ‘জয় বাংলা’ শিরোনামের এ প্রদর্শনীর চতুর্থ দিন গতকালও ছিল উপচে পড়া ভিড়।

কেউ গ্যালারি ঘুরে শিল্পকর্ম দেখছেন আবার কেউ কেউ স্মৃতির ফ্রেমে নিজেদের বন্দি করার জন্য ভাস্কর্য ও শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিল্পরসিকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রদর্শনীর গ্যালারি। শেষ হবে আগামী সোমবার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর