শনিবার, ১৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
কেমন হলো বাজেট । ড. আতিউর রহমান

স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন হার আরও বাড়ানো সম্ভব

স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন হার আরও বাড়ানো সম্ভব

একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশ্বমন্দা এবং মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সতর্ক একটি বাজেট ৯ জুন, ২০২২ মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। এ বাজেটটি নিয়ে আলাদা জন-আগ্রহ আগে থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। কারণ করোনাকাল পেরিয়ে অর্থনীতিতে যখন সবে গতি সঞ্চারিত হতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে শুরু হওয়া রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তাই আসন্ন অর্থবছরের বাজেট তৈরির সময় ভাবতে হয়েছে বহিরর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে আমদানি কমানোর কথা। পাশাপাশি একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর কথা ভাবতে হচ্ছে, অন্যদিকে করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের তৎপরতা বেগবান করার কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে। এসব বিবেচনায় রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য এমন একটি আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা বাজেটপ্রণেতাদের করতে হয়েছে যেটি অনুসরণ করে নাগরিকদের আর্থসামাজিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রবৃদ্ধি সচল রাখার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধার এগিয়ে নেওয়া যাবে।

আশার কথা এই যে, বাজেট প্রস্তাবটি দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাজেট-প্রণেতারা সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো যথার্থভাবে চিহ্নিত করে এগুলোর বিষয়ে সচেতন থেকেই বাজেট প্রস্তুত করেছেন। এ সংবেদনশীলতার বড় উদাহরণ হতে পারে জ্বালানি, সার ইত্যাদি বাবদ ভর্তুকি ও প্রণোদনায় দেওয়া বরাদ্দ বৃদ্ধি থেকে। আসন্ন অর্থবছরে এ বাবদ বরাদ্দ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। মোট হিসাবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে এটি বেড়েছে। জিডিপির শতাংশ হিসেবেও আসন্ন অর্থবছরে এ বয়াদ্দের অনুপাত বেড়েছে। চলতি বছরে জিডিপির শতাংশ হিসেবে ভর্তুকি ও প্রণোদনা ১.৭ শতাংশ। আসছে বছরে হচ্ছে ১.৯ শতাংশ। অথচ বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জিডিপির শতাংশ হিসেবে চলতি বছর থেকে আসছে বছরে বাজেটের আকার ও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দুটোই কিন্তু কমাতে হয়েছে। এর মধ্যেও ভর্তুকি ও প্রণোদনার অনুপাত বৃদ্ধিকে স্বাগত জানাতেই হবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এ অনুপাত প্রয়োজনবোধে আরও বাড়ানো হতে পারে। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে আসছে বছরের জন্য কিছুটা সংকোচনমুখী বাজেট কাম্য ছিল। তবে অংশীজনেরা আরও আগে থেকেই বলে আসছিলেন এ কাটছাঁটের ছাপ যেন স্বাস্থ্য খাতের ওপর না পড়ে। প্রস্তাবিত বাজেটে কাটছাঁট হয়নি। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে ৩২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে আসছে বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা হয়েছে। তবে উল্লেখ্য যে, এ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রতি বছর একইভাবে বাড়ছে। ফলে মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবে এ খাতে বরাদ্দ অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। চলতি বছরের সংশোধিত এবং আসছে বছরের প্রস্তাবিত এ দুটো বাজেটেই মোট বরাদ্দের ৫.৪ শতাংশ রাখা হয়েছে এ মন্ত্রণালয়টির জন্য। গত এক দশক ধরেই এ অনুপাত ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের চাহিদা এবং সমতুল্য অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরা এ অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি করার পক্ষে। আমরা আসছে বছরে মোট বাজেটের অন্তত ৭ শতাংশ এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের সংশোধিত বাজেট এবং আসছে বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনাটি আরেকটু ভেঙে করা যায়। মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটকে পরিচালন ও উন্নয়ন এ দুই ভাগে ভাগ করে যদি দেখি তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মোট স্বাস্থ্য বাজেট যেখানে ১৪ শতাংশ বেড়েছে সেখানে স্বাস্থ্যের পরিচালন বাজেট বেড়েছে ১২ শতাংশ, আর উন্নয়ন বাজেট বেড়েছে ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ উন্নয়ন বাজেটের প্রবৃদ্ধি বেশি। শুধু তাই নয়, মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটে চলতি বছরে পরিচালনের অংশ বেশি হলেও আসছে বছরে উন্নয়নের অংশটুটু বেশি হবে। ফলে ধরে নেওয়া যায়, স্বাস্থ্য খাতে সেবার আওতা ও নতুন নতুন সেবা যুক্ত করার জন্য আসছে বছরে বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগ, অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেববা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয়টির বাজেটের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক বেশি হতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মোট উন্নয়ন বাজেট ১৮ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপির স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। কারণ এডিপির আওতায় এ মন্ত্রণালয়টি ছাড়া আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ/ব্যুরো স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ পেয়েছে। চলতি বছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদের তুলনায় আসছে বছরের এডিপিতে স্বাথ্যে বরাদ্দ ৪০ শতাংশ বেশি। প্রস্তাবিত এডিপিতে তিনটি নতুন প্রকল্পসহ স্বাস্থ্যের জন্য মোট প্রকল্পের সংখ্যা ৫৮টি। স্বাস্থ্য খাতে এডিপি বরাদের ৪৬ শতাংশ আসছে উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া প্রকল্প সাহায্য থেকে। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষভাবে উল্লেখ্য বরাদ্দগুলোর মধ্যে আছে- পাঁচটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন। কনোকালে গৃহীত ‘কভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ এবং ‘কভিড-১৯ রেসপন্স ইমারজেন্সি অ্যাসিটেন্স’ প্রকল্প দুটো আসছে বছরে চলমান থাকছে। করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে (ইতোমধ্যে ২৬ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে)। সমন্বিত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল নীতিমাল, ২০২০-এর আওতায় মৌলিক গবেষণা চলমান রাখা হয়েছে এবং এজন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অসংক্রামক রোগের সঠিক চিকিৎসায় রোগীর তথ্য সংরক্ষণের জন্য এমআইএস সফটওয়্যার সংযোজন এবং ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ অর্জনের লক্ষ্যে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের কথা বাজেট বক্তৃতায় এসেছে। সব মিলিয়ে বাজেট ২০২২-২৩-এ স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া বরাদ্দকে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীলই মনে হচ্ছে। তবে এও মানতে হবে যে, এ বরাদ্দ আরও একটু উদার হতে পারত। সম্পদের সংকট এবং মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের ট্র্যাক রেকর্ড বিবেচনায় নিয়েই হয়তো বাজেট-প্রণেতারা আরও বরাদ্দ দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, অন্যান্য খাতে এ মুহূর্তে খুব জরুরি নয় এমন বরাদ্দ আরেকটু কমিয়ে তা থেকে স্বাস্থ্যের জন্য বাড়তি বরাদ্দ নিশ্চিত করা যেত। পুরো বাজেটে এমন কিছু মূলধন/উন্নয়ন ব্যয় রয়েছে যেগুলোয় চাইলে কাটছাঁট করা যায়। আর মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের অপারগতার কারণে কম বরাদ্দ দেওয়ার চেয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়ানো যায় সেটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। বরাদ্দে আরেকটু উদার হলে কেমন হতো আসছে বছরের স্বাস্থ্য বাজেট? আমরা মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশের পরিবর্তে ৭ শতাংশ স্বাস্থ্যের জন্য চেয়েছিলাম। তাহলে স্বাস্থ্য বাজেটের আকার হতো ৪৭ হাজার কোটি টাকার বেশি (অর্থাৎ প্রস্তাবিত বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি)। বর্ধিত বরাদ্দের অন্তত ৪৫ শতাংশ যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেওয়া হয় আমরা সে দাবিও জানিয়েছি (প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিকে বরাদ্দ মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ৩৪ শতাংশ)। স্বাস্থ্য বাজেটের আকার উল্লিখিত মাত্রায় বাড়িয়ে তার ৪৫ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় দিলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ বরাদ্দ হতো ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি (অর্থাৎ প্রস্তাবিত বরাদ্দের চেয়ে ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেশি)। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় এ বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া গেলে তার সম্ভাব্য সুফল কী হতে পারে। ‘উন্নয়ন সমন্বয়’-এর বাজেট গবেষক দল সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখিয়েছে যে, স্বাস্থ্য খাতের ‘মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিক্যাল সাপ্লাই’ উপখাতে বাড়তি ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারলে এবং ‘নগদ বেতন ও মজুরি’ উপখাতে বাড়তি ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারলে গ্রামাঞ্চলের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে এবং নাগরিকদের ‘আউট অব পকেট হেলথ এক্সপেন্ডিচার’ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের নাগরিকরা স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ বহন করছেন। এভাবে বরাদ্দ দেওয়া গেলে এ অনুপাত কমে ৫১ শতাংশ হতো। কাজেই দেখা যাচ্ছে আমরা যে বাড়তি ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়াতে বলছি তা দিয়ে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থীদের ‘আউট অব পকেট কস্ট’ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো সম্ভব। আগেই বলেছি বাড়তি বরাদ্দের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্তত প্রস্তাবিত বাজেটের অন্যান্য তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দে কাটছাঁট করেই পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবার জন্য বাড়তি আর্থিক সহায়তা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়াও বাংলাদেশের জন্য খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। বাজেট এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সংসদের ভিতরে ও বাইরে যে আলোচনাগুলো হচ্ছে তা আমলে নিয়ে কিছুটা হলেও পরিবর্তন-পরিবর্ধনের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ দরকারবোধে বরাদ্দ বাড়ানোর যে সময়োচিত ঘোষণা দিয়েছেন, সে নীতি স্বাস্থ্য খাতের জন্যও প্রযোজ্য হোক- এ প্রত্যাশা রাখছি। পরিশেষে বলতে চাই- বাজেট ২০২২-২৩-এর প্রস্তুতিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সব নাগরিকের জীবনমানের সুরক্ষার প্রশ্নে আমাদের নীতিনির্ধারকরা সংবেদনশীল থাকার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে এও মানতে হবে যে, অনেক ক্ষেত্রেই আরও ভালো করার সুযোগ ছিল।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর