রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্ব সবুজ নগরায়ণ প্রদর্শনীতে এক টুকরো বাংলাদেশ

মানিক মুনতাসির, নেদারল্যান্ডস থেকে

বিশ্ব সবুজ নগরায়ণ প্রদর্শনীতে এক টুকরো বাংলাদেশ

এক পাশে নেদারল্যান্ডসের আলমিরি শহরের ভিরওয়াটার লেক, অপর পাশে ফ্লোরিয়াদে শহর। মাঝখানে ঝকঝকে জলরাশি। আলমিরি শহরের চোখধাঁধানো ভবন ঘেঁষে বয়ে চলা লেক পেরোলাম ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। কিন্তু ইঞ্জিনে তেমন কোনো শব্দ নেই। চালক বারবার লেক সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছেন। লেকের দুই ধারে ফাঁকে ফাঁকে আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট। পুরো এলাকা যেন এক নয়নাভিরাম পরিবেশে সজ্জিত। লেকের স্বচ্ছ পানিতে ভাসছে অসংখ্য হাঁস। ঝকঝকে পানির নিচে মাছ, পাথর, এমনকি লতাগুল্ম দেখা যাচ্ছে। নৌকা এসে থামল ফ্লোরিয়াদে ঘাটে। কাঠের পাটাতন পেরোলেই মেলার প্রবেশপথ। পাড় দিয়ে গড়ে তোলা প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যই বলে দিচ্ছে ভিতরে সবুজায়নের প্রদর্শনী। ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল ক্যাবল কারে ঝুলছে আমোদপ্রিয় পর্যটক। প্রদর্শনী মাঠের পাশে কোনো এক ইংরেজি নাটকের মঞ্চায়ন চলছে। পাশেই এক মধুরকণ্ঠী শিল্পী গান গেয়ে যাচ্ছেন। আমরা ভিতরে ঢুকলাম। কিছুটা পথ পেরিয়ে ভারত, চীন, জার্মানি, তুর্কি, দুবাইয়ের প্যাভিলিয়ন ছেড়ে চোখ পড়ল কাঠ, বাঁশ, পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি শাপলা ফুলের আকৃতির এক বৃহৎ প্যাভিলিয়ন। ভিতরে শোভা পাচ্ছে পাটের তৈরি নানা রকম তৈজসপত্র। প্যাভিলিয়নের প্রবেশমুখে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে পতপত করে। কয়েকটি শাপলাপাতা ভাসছে কৃত্রিমভাবে বানানো পুকুরে। এটাই নেদারল্যান্ডসের আলমিরি সিটির ফ্লোরিয়াদেতে প্রায় তিন মাস ধরে চলা সবুজ নগরায়ণ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ওয়ার্ল্ড হর্টিকালচার এক্সপো। এই প্রদর্শনীতে পৃথিবীর ৩৭টি দেশ তাদের সবুজায়ন, ইকোসিস্টেম ও সবুজ নগরায়ণ তুলে ধরছে। বাংলাদেশ এর মধ্যে একটি। নেদারল্যান্ডস সরকারের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হওয়া এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়েছে ১৩ এপ্রিল। চলবে এ বছরের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত। এর মূল বিষয়বস্তু হলো, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। উষ্ণায়ন কমিয়ে পৃথিবীকে আরও টেকসই, বসবাসযোগ্য ও সবুজায়ন করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশই আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বিশ্বে সবুজ নগরায়ণ নিয়ে কাজ করছে অনেক দেশ। জাতিসংঘ থেকে বিশ্বকে আরও টেকসই, বাসযোগ্য করতে তাপমাত্রা কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে পৃথিবীকে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতি নির্দেশনা দিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। মেলায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সোনালি আঁশ পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের সমারোহ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পর্যটন, ইকোসিস্টেম, প্রাকৃতিক পরিবেশ, খাদ্যশৃঙ্খল ও নানা বৈচিত্র্যময়তা তুলে ধরা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসছেন পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। এমনিতেই গোটা ইউরোপজুড়ে চলছে গ্রীষ্মকালীন ছুটি। ফলে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকছে দিনব্যাপী। বাংলাদেশের পক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একক কোনো আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার মেলায় এটিই প্রথম অংশগ্রহণ। আর এই কার্যক্রমের লিড এজেন্সি হিসেবে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলাদেশের লিচু, আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল; মাছ ধরার যন্ত্রপাতি; পাটের তৈরি তৈজসপত্র। মেলায় নেদারল্যান্ডসের প্যাভিলিয়নের পাশেই ১০১ নম্বর প্যাভিলিয়নে বড় অক্ষরে লেখা ‘বাংলাদেশ’। এই মেলার বিশেষ্য হলো, এখানে সবকিছু সাজানো হয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে নিজ নিজ দেশের প্রকৃতি ও ইকোসিস্টেমের আদলে। মেলা প্রতি ১০ বছর অন্তর আয়োজন করা হয়। এবারের মেলাটি নেদারল্যান্ডসের আলমিরি শহরের ভিরওয়াটার ভেন্যুতে আয়োজন করা হয়েছে। এবারের এক্সপোর মূল থিম হচ্ছে গ্রোয়িং গ্রিন সিটি। এখানে করা হয়েছে বাংলাদেশের উঁচু ভবনের ছাদকৃষি ও ছাদবাগানের মডেল। প্রায় ৬০ হেক্টর বা ১৫০ একর জমি নিয়ে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নটি আমাদের জাতীয় ফুল শাপলার ১৮টি পাপড়ির ওপর দাঁড়ানো একটি প্রাকৃতিক প্যাভিলিয়ন, যার বেশির ভাগ পাটের তৈরি পণ্য ও পাটের আঁশ দিয়ে সাজানো। মেলার প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ ও এর প্রতিপাদ্য- ব্যাক টু দ্য জুট, ব্যাক টু দ্য ন্যাচার। এটাই তুলে ধরা হচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে। মেলায় বাংলাদেশ থেকে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাকের যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে আগামী ৩ জুলাই। মেলা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে অংশ নেওয়া কমিটির লিড প্রতিনিধি ড. মো. মেহেদি মাসুদ বলেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সবুজায়ন, প্রকৃতি ও কৃষিকে তুলে ধরা হচ্ছে বিশ্বের কাছে, যা আমাদের রপ্তানির বাজার ও পর্যটন সম্প্রসারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সর্বশেষ খবর