বুধবার, ২২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

শেষ মুহূর্তে খরচের উৎসব

সচিবালয়ে চলছে সংস্কার কাজের মহাযজ্ঞ, ব্যস্ত কর্মকর্তারা

উবায়দুল্লাহ বাদল

শেষ মুহূর্তে খরচের উৎসব

চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) বাকি আছে মাত্র ১০ দিন। অথচ এখনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মেরামত ও সংস্কার খাতের সব টাকা খরচ হয়নি। সময়মতো খরচ করতে না পারলে সরকারি কোষাগারে ফেরত যাবে এ খাতের অব্যয়িত টাকা। ‘কিন্তু তা কী করে হয়! যে কোনো মূল্যে খরচ করতে হবে এ খাতের সব অর্থ। কোনোভাবেই ফেরত দেওয়া যাবে না বরাদ্দের টাকা’- এমন মনোভাব অধিকাংশ কর্মকর্তার। তাই সচিবালয়ের বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চলছে ‘ধর মুরগি-কর জবাই’ অবস্থা। বরাদ্দের টাকা খরচ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মন্ত্রী-সচিবদের দফতর থেকে শুরু করে অনুবিভাগগুলোর কক্ষ-করিডোর এমনকি ওয়াশরুমেরও সংস্কার চলছে। সংস্কারের চেয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের দিকেই মনোযোগ বেশি কর্মকর্তাদের। বরাদ্দের অর্থ খরচ করতে এ মুহূর্তে সচিবালয়ের কমবেশি ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন দফতরে চলছে মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। এসব কাজে কাঠমিস্ত্রি, বৈদ্যুতিক লাইনম্যান, টেলিফোন অপারেটরসহ কারিগররা রাতদিন কাজ করছেন। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শোনা যাচ্ছে হাতুড়ি-বাটালের শব্দ। গতকাল সচিবালয়ে সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ কেউ বলেছেন, প্রতিটি অর্থবছরের শেষ মাসে বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ খরচের ধুম পড়ে যায়। যেসব আসবাবপত্র আরও কয়েক বছর ব্যবহার করা যেত, সেগুলোও বাদ দিয়ে নতুন আসবাবপত্র কেনা হয়। জুনে বরাদ্দ ফেরত না দিতে কারণে-অকারণে খরচ করেন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। রুম মেরামতের চেয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের দিকেই মনোযোগ বেশি তাদের। আর এসব করতে যত কেনাকাটা হবে ততই লাভ! প্রতিটি জিনিস বাজারমূল্যের চেয়ে ৫-৬ গুণ বেশি দাম ধরে খরচ করা হয়। সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যই থাকে সরকারি বরাদ্দের অর্থ ফেরত না দিয়ে খরচ করা। ফলে জুনের শেষ দিকে সরকারি দফতরগুলোয় সংস্কার ও মেরামতের হিড়িক পড়ে যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের বাজেট উইংয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, অর্থবছরের শুরুতে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবের রুম সংস্কার ব্যাপারে চিঠি এসেছিল। অর্থ বিভাগ সম্মতি দিয়েছিল। তবে শর্ত ছিল তাদের সংস্কারের ব্যয় ওই পরিচালনা খাত থেকে মেটাতে হবে। এখন অর্থবছরের শেষে এসে তারা কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ শেষ মুহূর্তে তাড়াতাড়ি কাজ করতে গিয়ে কাজের গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। গতকাল সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের দফতরের মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। সচিবের একান্ত সচিব শেখ হাফিজুর রহমানের কক্ষটি সংস্কার শেষ না হওয়ায় তিনি পাশের অন্য একটি কক্ষে বসে কোনোমতে দাফতরিক কাজ করছেন। প্রশাসনিক কাজে আসা দর্শনার্থীরা কেউ বসতে পারছেন না। দু-চার জন বসলেও বাকিরা দাঁড়িয়ে থেকেই কাজ সারছেন। প্রায় অভিন্ন চিত্র সমাজকল্যাণ সচিবের দফতরেও। এ চিত্র শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নয়, মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ের। সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শেষ হয়েছে। কাজ চলছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ আরও বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে। এ ছাড়া ৬ নম্বর ভবনের নিচতলায় সিলিংয়ের কাজ চলছে। কিছুদিন সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেছে ধর্ম, পানিসম্পদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন এখন অফিস করছেন প্রতিমন্ত্রীর রুমে। কারণ তাঁর রুম ডেকোরেশনের কাজ চলছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের কারণে প্রবেশের সুযোগ নেই বললেই চলে। সচিবের রুমসহ আরও কয়েকটি রুমের ডেকোরেশন চলছে। এভাবে বিদ্যুৎ বিভাগের বারান্দায় সিলিং কাজে ব্যস্ত সব কারিগর। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের রিসিপশনের জন্য সুন্দর ডেস্কের কাজ চলছে। পশ্চিম পাশের ওয়াশরুমের সংস্কার কাজও করছেন তারা। এসব কাজে যুক্ত একাধিক কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজ ধরা হয়েছে কয়েকদিন হলো। শেষ করতে হবে আগামী সপ্তাহের মধ্যে। এজন্য তারা অফিস টাইমের পরও কাজ করছেন।

জুনের শেষ দিকে কেন সংস্কার ও মেরামতের হিড়িক পড়ে যায়- এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অর্থবছর শেষ হওয়ার সঙ্গে বাজেটে পরিচালনা খাতে বরাদ্দ অর্থ ফেরত দিতে হয় যদি বরাদ্দ অর্থ পুরো ব্যয় করতে না পারে। যেন ফেরত না যায় সেজন্য অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নতুন অর্থবছরের বাজেট পাস হওয়ার আগেই মেরামতসহ সৌন্দর্যবর্ধনের বিভিন্ন কাজ করে। আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পরিচালনা খাত থেকেই ব্যয় করতে হয়। এসব কাজের ঠিকাদারের বিল সময়মতো পেশ করা বাধ্যবাধকতা হয়ে যায়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর