বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বন্যার অবনতির শঙ্কা

সিলেটে বৃষ্টি, বেড়েছে নদীর পানি, সুনামগঞ্জে তলিয়েছে নিম্নাঞ্চল

প্রতিদিন ডেস্ক

বন্যার অবনতির শঙ্কা

লালমনিরহাটের অনেক এলাকায় চলে ভেলায় যাতায়াত -বাংলাদেশ প্রতিদিন

আবারও বন্যার অবনতি ঘটার শঙ্কার কথা জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দেশের ছয়টি নদীর সাতটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। এরই মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং উজানে দেশের বাইরের অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। ফলে গঙ্গা-পদ্মা ও কুশিয়ারা ছাড়া দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে, যা আগামী ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও জানিয়েছে, আগামী ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের (জলপাইগুড়ি, সিকিম) বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এতে ওই সময়ে মূলত দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান (তিস্তা, আপার আত্রাই, ধরলা, দুধকুমার, আপার করতোয়া, টাঙন, পুনর্ভবা ও কুলিখ) নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ১২ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে, ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টে, দুধকুমার নদীর পাটেশ্বরী পয়েন্টে এবং করতোয়া নদীর পঞ্চগড় পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপরে বা কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে। এ অবস্থায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে। অন্যদিকে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

এদিকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরাও গতকাল সন্ধ্যায় বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ খবর পাঠিয়েছেন-

সিলেট : মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে ভারী বৃষ্টির কারণে ভীতি জেগেছে মানুষের মনে। প্রায় ৬ ঘণ্টায় অবিরাম ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরীর রাস্তাঘাটে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়তে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। সিলেট নগরীর নিচু এলাকাগুলোর বাসাবাড়িতেও পানি প্রবেশ করে। ভারী বৃষ্টির কারণে সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার পানি ফের বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গতকাল বিকাল ৩টায় সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম না করলেও আগেরদিন সন্ধ্যার চেয়ে বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কানাইঘাট পয়েন্টেও। এই পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে পানি। কুশিয়ারা নদীর আমলশিদ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১.১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শেওলা এবং ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টেও কুশিয়ারার পানি বইছে বিপজ্জনকভাবে। ভারী বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সিলেটের হাওর ও নিম্নাঞ্চলে ফের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার শেষ হতে না হতেই আবারও বাড়ছে নদ-নদী আর হাওরের পানি। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে জেলাজুড়ে। গতকাল সুরমা নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুনামগঞ্জে ষোলঘর পয়েন্টে সুরমার পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯৬ মিলিমিটার। ভারী বর্ষণ আর ভারতের ঢলে জেলার দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলার নিম্নাঞ্চলে অবনতি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির। যে কারণে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ঘরে ফিরতে দ্বিধায় পড়েছেন অনেক বানভাসি।

রংপুর : উজানের ঢল এবং ভারী বৃষ্টিপাতে তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পানি প্রবাহ অব্যাহত থাকলে তিস্তা পাড়ে আবারও বন্যা দেখা দেবে। সেই সঙ্গে দেখা দেবে নদী ভাঙনও। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, উজানের পাহাড়ি ঢলে বিকালে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই সময়ে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার কিছুটা নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই পয়েন্ট পানি আরও বৃদ্ধি পাবে। এদিকে যমুনেশ্বরী নদী বদরগঞ্জ পয়েন্টে, ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা পয়েন্টে, করতোয়া নদী চক রহিমপুর পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বিকাল ৩টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

লালমনিরহাট : বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির এক সপ্তাহ পর ফের অবনতি হয়েছে লালমনিরহাটে। প্রায় ১০ দিন পর গতকাল সকাল থেকে তিস্তার পানি ব্যারাজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানিও জেলার কুলাঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবৃদ্ধির কারণে জেলার শতাধিক চরের মানুষ পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, উঁচু রাস্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা ধরলায় শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিকাল ৩টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ব্যারাজ পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিক (৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) চেয়ে ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নীলফামারী : নীলফামারীতে ফের বিপৎসীমার ওপরে উঠেছে তিস্তার পানি। গতকাল বেলা ৩টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে করে ডিমলা উপজেলার তিস্তাবেষ্টিত নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় ফের বন্যার হুমকিতে পড়েছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের চার সহস্রাধিক পরিবার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বহমান পদ্মা নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। তাই পদ্মার ভাঙন থেকে বাঁচতে নিরাপদ স্থানে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন পদ্মা তীরবর্তী গ্রামের মানুষজন। গত কয়েকদিন থেকে উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের মনোহরপুর এলাকায় পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের আবাদি জমিসহ একাধিক ভিটামাটিতে ভাঙন ধরেছে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে সবকটি নদ-নদীর পানি গত চার দিন ধরে কমলেও টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে ফের গত সোমবার রাত থেকে বাড়তে শুরু করেছে সবগুলো নদীর পানি। ফলে দ্বিতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুুল্লাহ আল মামুন জানান, ২৪ ঘণ্টায় আবারও ধরলা নদীর পানি দ্রুত বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এ ছাড়াও তিস্তা, দুধকুমর ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি ফের বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কাজিপুর পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার নিচ প্রবাহিত হচ্ছে। সাত দিনের ব্যবধানে ফের পানি বাড়ায় যমুনা পাড়ের মানুষ বন্যার শঙ্কায় ভুগছেন। পানি বাড়ায় যমুনার অরক্ষিত অঞ্চল শাহজাদপুর, চৌহালী ও এনায়েতপুরে নদী তীরবর্তীরা ভাঙনের শঙ্কা করছেন। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, সাত দিনের ব্যবধানে ফের যমুনার পানি বাড়তে শুরু করেছে। বন্যার পুর্বাভাস অনুযায়ী আগামী দুই থেকে তিন দিন সামান্য বাড়বে। তবে আশঙ্কার কিছু নেই।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের বন্যার পানি কিছুটা কমেছে। হবিগঞ্জ সদর, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, নবীগঞ্জ, মাধবপুর ও লাখাই উপজেলার বন্যা পরিস্থতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে পানি বিপৎসীমার ৮.৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের আইরল আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১০টি ঘরেই এখন পানি। ফলে ঘরগুলোর বাসিন্দারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘরগুলো তুলনামূলক নিচু স্থানে তৈরি করার কারণে অন্য ঘরবাড়িতে পানি না উঠলেও আশ্রয়ণ প্রকল্পটি দ্রুতই জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দাউদকান্দি (কুমিল্লা) : কুমিল্লার গোমতী নদের পানির বিপৎসীমা অতিক্রম করায় স্থানীয় তিতাস উপজেলার কয়েকটি গ্রামের ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, মাছের ঘেরসহ ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও তিতাস উপজেলার প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, তিন দিন গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বর্তমানে পানি কমতে শুরু করেছে। তাতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর