বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

আগুনের সূত্রপাত রাসায়নিকে

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি তদন্ত প্রতিবেদন

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি রাসায়নিক থেকেই সূত্রপাত হয়। একই সঙ্গে এ ঘটনায় মালিকপক্ষ ও তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো দায় এড়াতে পারে না।  বিস্ফোরণের ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমান।

তদন্ত কমিটি এক মাস ধরে ২৪ জন প্রত্যক্ষদর্শী, বিএম ডিপোর মালিক ও কর্মকর্তা, স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে ১৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি তৈরি করে। এ ছাড়া কমিটি সুনির্দিষ্ট ২০টি সুপারিশও প্রদান করে। দুর্ঘটনার পর মোট ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ও বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।

বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর সরকারের নির্দেশে একটি তদন্ত গঠন করা হয়। কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আমরা প্রতিবেদনটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাব। সেখান থেকে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। নির্দেশনামতে আমরা কাজ করব। স্থানীয়ভাবে আমরা কিছু বলতে পারি না।’ তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিএম ডিপোর ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর এর কারণ, দায়দায়িত্ব নিরূপণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় তদন্ত কমিটির ওপর। আমরা সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করেছি। দুর্ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়েছি, কারা এর জন্য দায়ী তা নির্ধারণের চেষ্টা করেছি। তবে এ ঘটনায় বৃহত্তর স্বার্থে আরও বড় তদন্ত হতে পারে। প্রতিবেদনে আগামীতে করণীয় নিয়ে ২০টি সুপারিশ রাখা হয়েছে।’

উল্লেখযোগ্য সুপারিশ : বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করে কমিটি যে ২০টি সুপারিশ করেছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কনটেইনার ডিপো পরিচালনা-সংক্রান্ত ১৯৫৩ সালের বিপজ্জনক পণ্য আইনটি সংশোধন বা সময়োপযোগী করা, ডিপো তদারকিতে থাকা ২৫টি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, সংস্থাগুলোর ডিপো পরিচালনা-তদারকি জোরদার করা, ডিপো পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দফতরগুলোকে একই প্ল্যাটফরমে আনা। কারণ কনটেইনার ডিপোর অনুমোদন, পরিচালনা ও তদারকিতে ২৫টি সংস্থার ভূমিকা আছে। সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় ঘটলে ভবিষ্যতে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে সুপারিশমালায় উল্লেখ করা হয়।

তদন্তে তিন ইস্যু : বিএম কনটেইনারে বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বিশেষ তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্তকাজ পরিচালনা করে। এর মধ্যে রয়েছে- ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে করণীয় নির্ধারণে সুপারিশ প্রণয়ন। এসব বিষয় সামনে রেখে কমিটি সামগ্রিক কাজ পরিচালনা করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি : বিএম ডিপোর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি গ্রহণ করে। ৪ জুন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ৫ জুন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ৮ জুন তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে। প্রত্যক্ষদর্শী কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মো. রাকিব হাসান বাপ্পী বলেন, ‘ঘটনার পর খবর পেয়ে আমরা বিএম ডিপোতে পেলাম। একটির ওপর একটি কনটেইনার রাখা। তিন-চারটি করে। নিচের একটিতে ধোঁয়া বের হচ্ছে। প্রচুর হিট। পাইপ আমার হাতে ছিল। আধঘণ্টা পরই আমি টায়ার্ড হয়ে যাই। আমার ওস্তাদ এমরান আমাকে পাম্পের ফোর্স বাড়াতে বলেন। আমি সেখানে গিয়ে ফিরতেই বিস্ফোরণ। আমার কান বন্ধ হয়ে যায়। চোখ জ্বলে। আমি কিছু দেখি না।’

আলোচিত আল রাজী কেমিক্যাল পরিদর্শন : বিএম কনটেইনার স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। স্মার্ট গ্রুপের অপর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাটহাজারী উপজেলার ঠান্ডাছড়িতে অবস্থিত আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স। তদন্ত কমিটি এটি সরেজমিন পরিদর্শন করে। কমিটি প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে, যেসব কনটেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে সেগুলো রপ্তানির জন্য সিন্ড করা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বোঝাই ছিল।

ওই হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে এক বছর ধরে প্রস্তুত করা হচ্ছে। কমিটি আল-রাজী কেমিক্যালের পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করে। বিশেষ করে জেরিক্যানের প্যাকেজিং এবং রপ্তানি-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফ্যাক্টরির জিএম মো. ইব্রাহিম খলিল ও চিফ মার্কেটিং অফিসার দেওয়ান মাহমুদুর রহমান পল্লবের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

প্রসঙ্গত, ৪ জুন রাত ৯টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকার বিএম কনটেইনারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪৯ জন মারা যান এবং আহত হন তিন শতাধিক। নিহতদের মধ্যে শনাক্তদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলেও ২০ জনের মরদেহের পরিচয় না মেলায় তাদের লাশ এখনো হস্তান্তর করা যায়নি। ইতিমধ্যে ডিএনএ টেস্টের জন্য অজ্ঞাতদের স্বজনদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিবেদন এলে শনাক্ত হওয়ার পর পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। সর্বশেষ গতকালও মাথার খুলি ও হাড় পাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর