শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক নিয়ে

জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে উপকূলীয় এলাকায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত

প্রতিদিন ডেস্ক

উৎকণ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক নিয়ে

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে বন্যায় বিলীন হয়ে যাওয়া সড়ক -বাংলাদেশ প্রতিদিন

উৎকণ্ঠা এখন ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক নিয়ে। সিলেটে বন্যায় সড়কের ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার। সুনামগঞ্জে ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার। এ ছাড়া গতকাল জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে উপকূলীয় এলাকায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ভোলার ইলিশা ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাট; বাগেরহাটে ৪০ গ্রামের ২৫০টি মাছের খামার; সাতক্ষীরায় ছয় গ্রামের নিম্নাঞ্চল, হাজার হাজার বিঘা মৎস্যঘের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। বরগুনায় জোয়ারের পানিতে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সিলেট : সিলেটে দুই দফা বন্যায় সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এখনো বিভিন্ন স্থানে পানিতে তলিয়ে আছে সড়ক। যেসব স্থান থেকে বন্যার পানি নেমেছে সেসব স্থানের সড়কগুলো মারাত্মক ক্ষত নিয়ে ভেসে উঠেছে। কোথাও কোথাও বন্যার পানির তোড়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে পাকা সড়ক। কোথাও খানাখন্দ ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টির হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে ওইসব সড়কে চলছে যানবাহন। সড়ক ও জনপথ (সওজ), স্থানীয়  সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) ও সিটি করপোরেশনের হিসাবমতে, এবারের বন্যায় সিলেটে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক সংস্কারে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিলেটে মে মাসে প্রথম দফা বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতে জুনে ফের বন্যা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় মহাসড়ক, আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়ক। হাজার হাজার কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা শহরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সব উপজেলার যোগাযোগ। বর্তমানে বেশির ভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও স্বাভাবিক হয়নি সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। ভয়াবহ বন্যার স্রোতে নগর থেকে সীমান্তবর্তী গ্রামীণ জনপদ- সব এলাকার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় পাহাড়ি ঢল ও বন্যার স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে পাকা সড়ক। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তলিয়ে যাওয়া অবস্থায় যেসব সড়ক দিয়ে যান চলাচল করেছে সেগুলো। বন্যার পানি নেমে গেলে ওইসব সড়ক ভেসে উঠছে বড় বড় গর্ত ও খানাখন্দ নিয়ে। এসব সড়ক হয়ে পড়েছে যান চলাচলের অনুপযোগী। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। চলতি বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) এলাকার ১৮৬ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিসিকের প্রকৌশল শাখার হিসাবমতে, সড়ক ছাড়াও মহানগরের ৯৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার ড্রেন, প্রায় ১ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল, ৬০ কিলোমিটার ফুটপাত ও ৮২ কিলোমিটার পানির লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরসিসি রাস্তা ছাড়াও বেশ কিছু এসপল্ট ও সিসি রাস্তাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। তিনি জানান, সড়কের এ ক্ষতি পোষাতে ৩২৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। সওজসূত্র জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন ১৭টি রাস্তার ১৬৬ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারি-গোয়াইনঘাট ও দরবস্ত-কানাইঘাট সড়ক। সওজ, সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিয়ানীবাজার উপজেলার কয়েকটি স্থানে এখনো সড়কের ওপর পানি রয়েছে। সওজের আওতাধীন সড়কের ৫৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে এলজিইডির আওতাভুক্ত গ্রামীণ সড়ক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বন্যায় এলজিইডির প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এলজিইডি, সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী এনামুল কবীর জানান, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোয় ইট-বালু ফেলে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে।

সুনামগঞ্জ : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ঘরবাড়ি, অবকাঠামোর পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে জেলার সড়কগুলোর। ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার সড়ক আংশিক ও সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বানের পানির তোড়ে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ১৬ জুন বন্যাকবলিত হয় হাওর-অধ্যুষিত প্রান্তিক জেলা সুনামগঞ্জ। তলিয়ে যায় বাসাবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনাসহ জেলার সব সড়ক। যান্ত্রিক গাড়ির বদলে সড়কের ওপর দিয়ে চলাচল করতে থাকে ছোটবড় নৌযান। স্থানীয় সূত্র জানান, বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জ, মদনপুর-দিরাই, সুনামগঞ্জ-ছাতক, সুনামগঞ্জ-সাচনা, সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর, নিয়ামতপুর-জামালগঞ্জ, কৈতক-সিরাজগঞ্জ, ছাতক-দোয়ারাবাজার, জালালপুর-দোয়ারাবাজারসহ জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর বিভিন্ন স্থান পানির তোড়ে ভেঙে যায়। কোথাও সৃষ্টি হয় বড় বড় গর্ত। ১৩টি সড়কে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) জানায়, বন্যায় তাদের ৪ হাজার ৫৭১ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে অন্তত ২ হাজার কিলোমিটার বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০টি সড়কে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২০টি সেতু-কালভার্ট ও সেগুলোর সংযোগসড়ক। এতে অন্তত ১ হাজার ৫০০ কোটির টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। সুনামগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম বলেন, বন্যায় প্রায় সব সড়কই পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। ২ হাজার কিলোমিটারের মতো সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ওপরে। তবে কয়েকটি উপজেলা এখনো পানির নিচে থাকায় প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে বিলম্ব হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের আটটি সড়কের ১৮৪ কিলোমিটার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যান চলাচল বন্ধ রয়েছে তিনটি সড়কে।

সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক বলেন, প্রাথমিকভাবে ৩০০ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।

ভোলা : ভোলায় পূর্ণিমার অতি জোয়ার ও উজানের পানির চাপে মেঘনায় জোয়ারের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইলিশা ফেরিঘাটের লো-ওয়াটার ও হাই-ওয়াটার দুটি ঘাটই তলিয়ে যাচ্ছে। ফেরি থেকে যানবাহন ওঠানামা ব্যাহত হচ্ছে। ইলিশা লঞ্চঘাটও প্রতিদিন দুই বেলা ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে থাকে। যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে ওঠানামা করে। এ ছাড়া মেঘনা, তেঁতুলিয়া নদীতে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চল এবং বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের শ শ পরিবার পানিবন্দি।

বাগেরহাট : নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মোরেলগঞ্জ পৌরসভাসহ উপকূলীয় তিন উপজেলা মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও শরণখোলার ১৮টি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মোরেলগঞ্জ ও রামপালে পুকুরসহ ২৫০টি মাছের খামার তলিয়ে গেছে। মোরেলগঞ্জ বাজারসহ পৌরসভার কুঠিবাড়ি ও বারইখালী গ্রামের সড়ক প্লাবিত হয়ে ও ফেরিঘাট থেকে পুরনো থানাঘাট পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে হুহু করে পানি ঢুকছে উপজেলা সদরে। মোরেলগঞ্জ পৌরসভার সড়ক, দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

সাতক্ষীরা : সুন্দরবনসংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে শ্যামনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার হেক্টর মৎস্যঘের ও ছোটবড় পুকুরের মাছ। পানিবন্দি শতাধিক পরিবার। বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দুর্গাবাটি সাইক্লোন শেলটার সংলগ্ন এলাকায় নদীর প্রবল জোয়ারে ২০০ ফুট এলাকাজুড়ে উপকূলরক্ষা বাঁধ ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুনরায় জোয়ার শুরু হলে হুহু করে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে।

বরগুনা : পূর্ণিমাতিথির প্রভাবে উপকূলীয় জেলা বরগুনার ছয় উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ চার দিন ধরে পানিবন্দি। বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারী শ শ পরিবার অনাহার-অর্ধাহারে রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কয়েক শ পানিবন্দি পরিবারের মধ্য বৃহস্পতিবার তালতলীর ৭০টি পরিবারকে ১০ কেজি চাল, ১ লিটার তেল, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি চিনি, ১ প্যাকেট গুঁড়া দুধ ও সেমাই দেওয়া হয়েছে। বরগুনা সদর উপজেলার ড্যামা, গুলিশাখালী, মাঝের চর, কাটাখালী, পাতাকাটা, খাজুরতলা আশ্রয়ণ, আবাসন, পোটকাখালী আবাসন, ডালাভাঙ্গা, মোল্লার হোড়া, লতাকাটা, ছোনবুনিয়া, উরবুনিয়া, পালের বালিয়াতলী, গাজী মাহমুদ, সোনাতলা, গোড়াপদ্মা, গর্জনবুনিয়া; বেতাগী উপজেলার, ঝোপখালী, কেওয়াবুনিয়া, কালিকাবাড়ী, সরিষামুড়ী; বামনা উপজেলার, দক্ষিণ কাকচিড়া; আমতলী উপজেলার আমতলী লঞ্চঘাট, বাসুকী, লোচা, বালিয়াতলী, আঙ্গুলকাটা, গুলিশাখালী জেলেপাড়াসহ বেড়িবাঁধের বাইরের বসতবাড়ি জোয়ারের পানিতে চার দিন ধরে তলিয়ে আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর